কেমন আছেন, মামা?
ইয়াসিন দু-বছরে অনেক বৃদ্ধ হয়েছে। বলে, বাপ যেমন ছিলাম তেমনই আছি। তোর বাপই ঠিক বলিছিল, হামরা পাখমারা আর বাদিয়া মোছলমানের মতোই বেজাত মোছলমান হেই গেলাম।
বেজাত মোছলমান!
হাঁ! হাজিসাহেব কহেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, মোছলমানের কিরাকাম মানো, হাদিস মানো, তবিই তুমু সাচ্চা মোছলমান হবা। জাতে উঠবা। তা বাপ, সবই তো করি, কেন্তু জাতে তো উঠি না!
জাতে উঠেন না!
না বাপ, বেটিগুলার বিহা হয় না। মোছলমান হয়া হামরাদের ঘর তো ফের কমি গেল।
হাজিসাহেরা একসাথ ওঠ বস করেন না?
নামাজ পড়া যদি একসাথ ওঠ বস হয়, তো সিটা করে, আর কেছু লয়।
খানাপিনা?
ইয়াসিন মাথা নাড়ে।
কাজ কাম দেয়?
এনা দেয়, যেংকা ছিল।
আধি জমি?
আধি জমি রেকড হবার কথা শুনা যাচ্ছে। কাজিই এখন আর আধি লয়, এখন আলগা চুক্তি, মুনিষ-মাহির কি দিন-পাটা।
শারিবা চুপ করে বসে থাকে।
শা-জাদি বলে, ছাড় ইসব ছিড়া কথা, আন্ কথা ক’। টাউনোৎ খুব খাটনি তোর, না? তাই মুখটা এনা কালা হইছে?
শা-জাদি বলে, বয়স কত হোই গেল রে শারিবা, ইবার বিয়া সাদি করবা না?
শারিবা তখন অন্য কথা ভাবে। শারিবা ভাবে তার নানির কথা। তার নানি যেসব প্রাচীন কথা বলত, সেইসব পাপপুণ্যের কথা। বাজিকরদের নসিবের কথা। লুবিনি ধূসর চোখে পাতালু নদীর বাঁকের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকত জ্যোৎস্না রাতে। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে শাবিবাকে অলীক সব দৃশ্য দেখাত। লুবিনি বলত, হাঁই দেখ শারিবা, হাই দেখ রহু। ও
রহু কি করে, নানি?
রহু বাজিকরদের দেখে।
হামি দেখশর পাচ্ছি নাই, নানি।
নমনকুড়িতে পীতেম বলত, হাঁই দেখ লুবিনি, হাঁই দেখ রহু।
রহু কি করে নানা?
রহু বাজিকরদের দেখে।
হামি দেখার পাচ্ছি নাই, নানা।
রাজমহলের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অশরীরী দনু বলত, হাঁই দেখ পীতেম, হাঁই দেখ রহু।
পীতেম দেখতে পেত রহুকে, দেখতে পেত জামিরও। কিন্তু সেই কিশোরী বয়সে লুবিনি রহুকে দেখতে পায়নি, অথচ মরার আগে সে বহুকে দেখত। আবার সে যখন শারিবাকে দেখাত, শারিবাও রহুকে দিশা করতে পারত না।
এখন তার মনে হয় এদের সবার মতো সেও হয়ত একসময় রহুকে দেখতে শুরু করবে। এতে তার ভয় হয়। নানির বলা অসংখ্য কথা সে একসময় আবিষ্ট হয়ে শুনত এবং বিশ্বাস করত নানির বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে। এখন যদিও শারিবা এসব কথার কোনো অর্থ পরিষ্কারভাবে ধরতে পারে না, তবুও কেমন ভয় হয় অন্য আর সবার মতো একদিন রহু তাকে দেখা দেবে। বিষণ্ণ মূর্তিতে।
রহু বলবে, তুমি কে?
আমি শারিবা।
শারিবা কে?
শারিবা বাজিকর।
তবে তো তোমার খুব দুঃখ।
শারিবা বলবে, হ্যাঁ আমার বড় দুঃখ, আমার দুঃখের আসান নেই।
অথচ এখন তো শারিবা লুবিনির অসংখ্য গল্পকথার মধ্যে অন্য অর্থ খুঁজে বের করবার চেষ্টা করে। সমাজ তাকে কেন ত্যাগ করল? কেন এখনো গ্রহণ করে না। এখন এসব চিন্তা সে সূত্রবদ্ধ করার চেষ্টা করে। গ্যারেজে দুবছর শ্রমিকের কাজ করে তার হীনমন্যতা অনেক কেটে গেছে। শহরের জীবন যদিও অনেক জটিল কিন্তু তার বিস্তারও অনেক বেশি। মোহরের হাটখোলায় চায়ের দোকানে এখনো সম্প্রদায়িভিত্তিক কাপ ও কাচের গেলাস আছে, শহরে নেই। এখানে আর কিছু থাক আর নাই থাক, জাতের কথা গায়ে লেখা থাকে, শহরে অন্তত এরকম
অশ্লীলভাবে থাকে না।
ঘরে ফিরে এসে রূপা বলে, দেখে আসলি বেটা কেমন মোছলমান হয়েছে? আগে বলি নাই? তখন কেও হামার কথা শোনল না!
শারিবা একথারও উত্তর দেয় না। রূপা ও শরমী আরো ধর্মপ্রাণ হয়েছে, আরো আবেগ দিয়ে তারা বিষহরির পাঁচালি গান করে, বিষহরির ঘটের জন্য আলাদা একখানা চালা তুলেছে সেখানে ফুল, বেলপাতা, ধূপদীপ দেয়। রূপা এবং শরমীর আরো উন্নতি দেখতে পায় শারিবা। দুজনের গলাতেই হলুদ রঙের নতুন তুলসীর মালা। সন্ধ্যাবেলা রূপাকে সে নতুন গানও গাইতে শোনে—
শুনেছি রাম তারকব্রহ্ম
নয় সে মানব জটাধারী,
মহাপাতক হইয়াছ তুমি
করি লক্ষ্মীকান্তের লক্ষ্মী চুরি।
এবং পরদিন এক বৈরাগী ঠাকুর এলে শারিবা দেখে রূপা ও শমী বড় অকুণ্ঠ সেবা যত্ন করে তার। বৈরাগী তাদের ইহকাল পরকাল ও পাপপুণ্য নিয়ে অনেক রহস্যময় ও অজানা কথা বলে। তারা সেসব মনোেযোগ দিয়ে শোনে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক পরিবর্তন হয়েছে আকালুর। পাশী আকালু এখন আর নিজে গাছে ওঠে না। অসংখ্য তালগাছ ইজারা নেয় সে। তাড়ির গদি সরকারের কাছ থেকে ডেকে নেয়, দোকান খোলে। চৈত্র মাস থেকে তার ব্যবসা কয়েক মাদ রমরমা থাকে। সে ভালো টাকাই রোজগার করে। শীতের দিনে খেজুরগাছ ইজারা নেয় সে গৃহস্থের কাছ থেকে। রস নামিয়ে গুড় তৈরি করে। এতেও ভালো পয়সা থাকে তার।
আকালু স্থানীয় একটি পোলিয়া মেয়েকে বিয়ে করেছে। বাজিকরপাড়ায় থাকলেও তার ঘরদোরেই লক্ষ্মীর শ্ৰী আছে। এত তাড়ি নামায়, কিন্তু নিজে কখনো এক চুমুক মুখে তোলে না। তার বউ খুবই কাজের মেয়ে, ভালো গুড় জ্বাল দেয়।
শারিবা বলে, তবি তুই বাজিকরের বিটি বিহা করলু না।
কথায় কি আকালু হারে। বলে, বাজিকরের বিটি হামি বিহা করমো, তো বাজিকরের বেটাগুলা যাবে কুন্ঠি?
মোহর হাটখোলা এখন একযা বাজারের চেহারা নিয়েছে। আকালুর সেখানে একখানা মুদি দোকানও আছে। সে আজকাল লোককে টাকাও ধার দেয় সুদের বিনিময়ে। মোহর হাটখোলা এখন সরগরম জায়গা। সারাদিনে এদিকে ওদিকে চারখানা মোটর বাস যাতায়াত করে। লোজন হরদম শহরে যায়, শহর থেকে আসে। শারিবা শুনে অবাক হয় বাজিকরপাড়ায় কয়েকজন যুবক শহরে মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখতে যায়।