শা-জাদি আরো কাঁদে। শেষে বলে, এটা কথা দেও বাজিকর—
কী কথা? শারিবাক যাতে দিবা হামার কাছেৎ?
এলা এটা কথা! তোর বেটা তোর কাছে যাবে না?
ছাবালের বিহা দিবা তাড়াতাড়ি?
দিমো। দূরে সরি গেলাম বলে মনে দুঃখ রাইখবে না তো?
দূরে ক্যান্? কাছেই তো আছি। দেখিস, পর হয়ে যাবে না কেউ।
কি গভীর অন্ধকার। রূপা স্পর্শ করে শা-জাদির হাত। দু-জনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ।
৬১-৬৩. ছয় ঘর মুসলমান হয়নি বটে
ছয় ঘর মুসলমান হয়নি বটে, কিন্তু ভোজ খেতে রূপা, শরমী এবং এরকম দু-চারজন বাদে আর সবাই গিয়েছিল। জীবনে ভোজ খাওয়ার সুযোগ বাজিকরের কটাই বা আসে।
শারিবা এখনো হাসপাতালে। পলবি-হানিফের বিয়ে হয় উৎসবের পরদিনই বিশিষ্ট অতিথিদের সাক্ষী রেখে। পরদিন তারা হাসপাতালে শারিবার সঙ্গে দেখা করে।
শারিবাকে আরো দশদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। সেই দশদিন হানিফ-পলবিও শহরে থাকে। শারিবা ছাড়া পেলে হানিফ ছুটি নেয় অফিস থেকে। সে পলবিকে নিয়ে মালদায় নিজের বাড়ি যাবে। যদিও খুব আপন বলতে সেখানে তার কেউ নেই, তবু তো স্বজন কিছু আছে।
বাদা-কিসমৎ আর মোহরের যাবতীয় কথা শারিবা এদের কাছ থেকে শোনে। একদিন রূপা আসে। বলে, ঘরোৎ চল শারিবা।
ঘরোৎ গিয়া খামো কি?
হামি জিন্দা আছি, শারিবা।
তুমু খাটবেন, আর হামি বসে খামো?
এলা এটা কথা? শরীল সারলে নিজেই খাটবি।
আসলে ভাঙা বাজিকরপায় এই মুহূর্তে শারিবার যেতে মন চাইছিল না। সে যে কোনো একটা ছুতো খুঁজছিল। শেষপর্যন্ত রূপাকে সরাসরিই বলে, তুমু ফিরা যান, বাপ। হামি হানিফ ভাইয়ের কাছে কেছুদিন থাকমো। এটাকাজ কী চাকরি যদি পাওয়া যায়, সি চেষ্টাই দেখমো।
রূপা একটু শঙ্কিত হয়। বলে, তুই কি হামাক্ পর করি দিবার চাছিস, শারিবা?
শারিবা উঠে এসে বাপের দু-হাত নিজের হাতে নেয়। বলে, এংকা ভাবেন ক্যান, বাপ? কাজ কাম তত খুঁজি নিবার হবে। হানিফ ভাই সরকারি লোক, ভালোও বাসেন হামাক্। কেছুদিন দেখবা দেন। শরীলটা এটু সুস্থ হলে দেখশ করি আসমমা সবার সাথে।
একটু থেমে আবার বলে, আরেকটা কথা, হামার মাওরে বলেন, আমি তারই বেটা আছি, পর হই নাই।
রূপা শারিবার কথার বাস্তব দিকটা মেনে নেয় অগত্যা। হানিফকে বলে, জামাই তুমার হাতে রাখি গেলাম হামার পরানের পরান। দেখভাল করবা আর ফিরোৎ দিবা।
হানিফ তাকে অভয় দেয়। রূপা ফিরে আসে।
৬২.
মালদায় যাওয়ার পরই হানিফ একত্রে দুটি চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমত, শারিবার একটা গতি করা, আর তারপরে নিজের বদলির ব্যবস্থা। তার বিভাগীয় অফিস যেহেতু মালদাতেই, বদলির ব্যাপারে খুব একটা বেগ পেতে হয় না তাকে।
শারিবাকে নিয়ে তারপর সে যায় একটা রাস্তার পাশের চালাওঠা মোটর গ্যারেজে। চার-পাঁচজন যুবক সেখানে নানা ধরনের কাজ করে। মোটরের চাকায় পাম্প করা থেকে ওয়েলডিং অবধি অনেক কিছুই সেখানে হয়। অথচ গ্যারেজ বা দোকানটি অত্যন্ত অগোছালো, যেন দু-দিনের জন্য ব্যবস্থা। এক বৃদ্ধ, গোলগোল কাচের চশমা নাকে, একটা বড় মাপের খাকি জামা গায়ে, যার দু-টো হাতাই বগলের কাছ থেকে নেই, তদারক করে যুবকদের। যতই অগোছালো থোক, কাজের ব্যস্ততা খুবই।
হানিফ বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বলে, চাচা আসলাম।
সে একটা খাটিয়ায় বসে পড়ে বৃদ্ধের পাশেবৃদ্ধ চশমার মোটা কাচে ঠাহর করে বলে, কোন শালারে, সকালবেলা গলায় মধু।
আমি হানিফ, চাচা। অনেকদিন তুমার গাল শুনি না, তাই কলজেটা কেমন ড্যাপ মারি গিছে। দাও, দুটাশুনাও তো!
ওরে আমার শালারে, সক্কালবেলা, বিনিপয়সায় গাল শুনবে! ছাড় শালা, সিগ্রেট ছাড়, চা বল সব্বার জন্যে।
চা, সিগারেট, খোশগল্প হয়। হানিফের বিয়ের কথা শুনে আরেক প্রস্থ গালি শোনায় চাচা হানিফকে। শেষে শারিবাকে দেখিয়ে বলে, ও গাঁওয়ার ধর্মেন্দরটা কুনঠি থিকা আনলি?
ও শারিবা, আমার শালা।
শারিবা! তুই কি হিঁদু বিহা করেছিস নাকি হানফ?
আরে না না হিঁদু নয়, মুসলমানই। সিই তোমাদের উকিলবাবু আমিনুল সাহেব গেল না বাদা-কিসমতে মুসলমান করাতে, সেই মুসলমান।
নুতন মুসলমান? কামাল কল্লিরে, শোরের ছাও।
এখন কথাটা শোনো। শারিবারে কাম শিখাতে হবে, মেকানির কাম।
পারব না, আমার লোকের দরকার নাই।
তোমার পয়সা থোরাই খাবে ও। নিজে খাটে খাবে। এখন কামটা তো শিখাও।
হ্যাঁ, ওই বলে আমার ঘাড়ে চাপায়ে, নিজে ফুরুৎ হবা। ওসব তাল আমি বুঝি না!
শেষপর্যন্ত চাচার দোকানে শারিবার শিক্ষানবিশি শুরু হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, কখনো কখনো রাতেও কালিঝুলি মেখে শারিবা চাচার কাছ থেকে কাজ শেখে। ইঞ্জিন, চেসিস, কারবুরেটর, পেট্রল, ডিজেল এসব অদ্ভুত শব্দ শেখে। চেনে ক্লাচ, গিয়ার, ব্রেকের নিখুঁত কারিকুরি। চাচার কাছে গাল খায়, চড়চাপড়ও খায়। এইভাবে দিন মাস পার হয়ে বছর গড়ায়।
দু-বছর পরে শারিবা বলে, হানিফ ভাই, একবার বাড়ি যামো।
পলবি বলে, আম্মোও যামো। কতদিন বাপরে দেখি না, আপন মানুষ দেখি না।
একবছরে বাদা-কিসমতে পরিবর্তন কিছু হয়েছে। রাস্তা আরো দীর্ঘ হয়েছে। মোহরের হাট আরো বড় হয়েছে, আরো অনেক স্থায়ী দোকান হয়েছে। এখন নিয়মিত বাসও আসে।
বাজিকরপাড়ায় হিন্দু-মুসলমান পার্থক্য আবছা হলেও চোখে পড়ে। কিন্তু মানুষগুলো একইরকম রয়ে গেছে। সেই একই নিরম্ন হাঘরে সমাজ বহির্ভূত অসহায় বাজিকর।