সেবার অবশ্য ইয়াসিন আজুরাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এলা কি বেপার? কাগজে ছাপা দিলে কি হবে?
আজুরা তাদের খুব পণ্ডিতের ভঙ্গিতে, অনেক কিছু বোঝাবার ভঙ্গিতে বোঝাতে শুরু করে দু-চার কথার পর খেই হারিয়ে বলেছিল, ওলা তুমাদের বুঝবা হোবে না বাপু। ওলা মেলাই কঠিন বেপার, রাজনীতি। যেথায় মারবা কলাম ওঠি মাইরে দিবেন, বাস!
পাঁচ বছর পরের ভোটে তারা অন্য আরো দু-একজন নেতাকে দেখেছিল। তারা দেখেছিল আলাদা আলাদা ঝাণ্ডা এবং আলাদা দল। কেন এতসব পৃথক ব্যবস্থা, এই প্রশ্ন আর তার উত্তরের বীজ তাদের মস্তিষ্কে সেই সময় রোপিত হয়েছিল। এর জন্য কোনো কারণ নেই, শুধু তাদের প্রয়াসলব্ধ সামাজিক স্থিতি মস্তিষ্কে তাদের এই উপলব্ধিটুকু জাগিয়েছিল। খুব ক্ষীণভাবে হলেও এই দুইবারের অভিজ্ঞতায় বাজিকরেরা বুঝতে পেরেছিল, আজুরা, আজুরার প্রতিপক্ষ এবং আশপাশের অন্য আর কিছু মানুষের হয়ত তাদের কাছে কিছু গূঢ় প্রয়োজন আছে। এই বোধ আবার আত্মপ্রসাদ লাভ করার মতো যথেষ্ট ছিল না, কিংবা এই প্রয়োজনকে যে কাজে লাগানো যায় এমনও ইয়াসিন অথবা তার নেতৃত্বাধীন বাজিকরদের মনে হয়নি। কাজেই পরবর্তীকালে কনট্রোল, রেশনকার্ড, চিনি, কেরোসিন ইত্যাদি যেসব বন্দোবস্তগুলো বাদা-কিসমতের মতো গ্রামেও হয়েছিল, বাজিকরেরা তার ভাগিদার কিংবা দাবিদার হওয়ার কথা চিন্তাও করেনি। সামাজিক বিবর্তনের যে স্তরে এলে এইসব বন্দোবস্তের অংশীদার হওয়া যায়, বাজিকর যে কারণেই হোক নিজেকে সেখানে উত্তীর্ণ করতে পারেনি। সম্ভবত, ভীতিই ছিল এর প্রধান কারণ।
তারপর এবারে বাজিকরদের মুসলমান হওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব অসাধারণ কাণ্ডকারখানা ঘটছে বাজিকর তার দশা সবসময় ঠিক করতে পারছে না।
প্রথমে হাজিসাহেবের নির্দেশমতো সোনামিয়া যখন একগোছা কাগজ ইয়াসিনের হাতে দেয় তখন ইয়াসিন জানত না এগুলোর মূল্য কী। ছক কাটা কাগজে ক্ষুদে ক্ষুদে ছাপা লেখা, তার পাশে অথবা নিচে পেন্সিল দিয়ে সোনামিয়া কি সব লিখে দিয়েছে। সোনামিয়া বলেছিল এর নাম চেক। এ নাকি ভীষণ দরকারি দলিল। এখন তুমি মালিক হলে এই বসত জমির ভিটার। কেউ তোমাকে আর উচ্ছেদ করতে পারবে না, এমনই ক্ষমতা এই কাগজের। হবে না? ছাপা কাগজ, তাতে সরকারের লেখা। সে লেখার ক্ষমতা কি আজুরা মণ্ডলের থেকে বেশি? নিশ্চয়ই বেশি, না হলে হাজিসাহেব এমন নিশ্চিন্ত অভয় দেয় কি করে?
তারপরে আবার ভোটর হাওয়া বইতে শুরু করে। আজুরা এবার আর তাদের কাছে আসে না। তার এক ভাইপো এবার তার বিপক্ষ দলে যায়। সেই আসে, বাজিকরদের বোঝায় অনেক কিছু। মোহরের হাটে মাঝে মধ্যে বাজিকরেরা সভাসমিতি দেখে, আদিবাসীরা সেইসব মিছিলে মাদল ও ডুগডুগি নিয়ে সামিল হয়। নতুন নতুন মানুষ বাজিকরদের ভোট সম্বন্ধে বোঝাতে আসে।
তৃতীয়ত, ভায়রো সাপের কামড়ে মরে যাওয়ার পর বাজিকরদের ধর্মান্তরের বিষয়ে বিরোধের উত্তাপও কমে যায়। অবশ্য এজন্য ভায়রোর অনুপস্থিতিই প্রধান কারণ নয়। মানুষ এখানে এইরকমই। কিছু অপাঙক্তেয় বাজিকর মুসলমান হল কি খৃস্টান হল এতে কারোই বিশেষ কিছু যায় আসে না। তবুও বিষয়টা হাজি সাহেব ও তার সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেইজন্য বাজিকরেরা তাদের কাছে সমাদর পায়।
আর সবশেষে হানিফের এই প্রস্তাব ইয়াসিন ও সমস্ত বাজিকর গোষ্ঠীকে ভূমিকম্পের আন্দোলনের মতো নাড়া দেয়—গোরখপুরের শনিবারের ভূমিকম্পও এত শক্তিশালী ছিল বলে মনে হয় না।
কাজেই ইয়াসিনের মতো দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ একেবারেই দিশাহারা ও বিহ্বল হয়ে যায়। সে শুধু শারিবাকে বলতে পারে, দেখ শারিবা, বেবাক দিন যেন ঠিক থাকে।
৬০.
মহরমের দিন বাদা-কিসমতের মসজিদে ব্যান্ড-পার্টি আসে শহর থেকে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের গণ্যমান্য মুসলমানেরা হাজিসাহেবের অতিথি হয়। প্রায় দুশো জন শিশু, যুবা, বৃদ্ধ নরনারী মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয় কলমা পড়ে। একসাথে নামাজ হয়। সম্রান্ত মুসলমানেরা বাজিকর মুসলমানদের সঙ্গে পান তামাক বিনিময় করে। প্রত্যেকের নামের মধ্যে কিছু নতুনত্ব আসে। যাদের আগে থেকেই মুসলমানি নাম ছিল, তাদের পদবি বাজিকরের বদলে মণ্ডল হয়। যাদের নামে হিন্দুয়ানির ছোঁওয়া ছিল তাদের নতুন নামকরণ হয়। নতুন লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরা নতুন মুসলমানদের কিরকম বিহুল আর নির্বোধ দেখায়। তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু উপহার পায়। ভোজের প্রস্তুতি চলে। বেশ কয়েকটি গরু কাটা হয়েছে। মসজিদের প্রাঙ্গণ লাল নীল কাগজের পতাকায় সাজানো। চতুর্দিকে মুসলমানি উৎসবের হুল্লোড়। তার মধ্যে ম্রিয়মাণ লাজুক তিনজন মানুষ, যারা এই মুহূর্তে পুরানো অভ্যাস, পুরানো জীবন, পুরানো স্বজনদের ছেড়ুে চলে এসেছে। কেননা ছয় ঘর বাজিকর এখনো আগের জীবনকেই শ্রেয় মনে করছে। তারা চোখের জলে বিদায় দিয়েছে স্বজনদের। এরাও চোখের জল মুছেই এখানে এসেছে।
গতকাল সন্ধ্যায় শা-জাদি কপার অন্ধকার ঘরে গিয়েছিল। অন্ধকারে রূপা ঘরের দাওয়ায় বসেছিল। শা-জাদি শরমীকে আড়ালে যেতে বলেও অনেকক্ষণ চুপ থাকে। তারপর একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে, জেবনে চাই নাই কেছু, বাজিকর। খালি পর করি দিলা হামাক্! বার বার হামাক্ পর করি দিলা।
শা-জাদি ডুকরে কেঁদে ওঠে। রূপা বলে, শারিবার মাও, বাজিকরের জেবনে দেওয়ার কেছুই নাই। বেবাক ছাড়ি যাবার হয়। বাপ-দাদা-নানা হামরাদের থিতু করবার চালো, থিতু হবার পারি কই হামরা? এক দেশ থিকা আন্ দেশেৎ, এক সমাজ থিকা আন্ সমাজে হামরা যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। হামি ভাবি হামি হিন্দু, তুই ভাবো তুই মোছলমান। আসলে আমরা বেবাকেই সিই বাদিরা বাজিকরই আছি। দুঃখু করিস না শারিবার মাও, ই হামরাদের পাপের ফল।