অকল্পনীয় ক্ষিপ্রতায় আকালু ফিরে আসে। পাঁচিল থেকে নেমে দু-জনে প্রথমেই মাচান সরায়। পঞ্চাশ হাত যাওয়ার আগেই ভায়রোর চিৎকার শোনে তারা, কিসি কাটল হামাক্! ওরে পুষ্পর মাও-বিপিনা-এনা আলো আন, ওরে হামা বুঝি সাপে খালো–
দুজনে একটু থমকে দাঁড়ায়, তারপর নিঃশব্দে মাঠে নেমে ছুটতে শুরু করে। সকাল হতে তখনো ঘন্টাতিনেক বাকি।
পরদিন রোদ ওঠা পর্যন্ত রূপা জেগে থাকে ও নেশা করে তারপর ভায়রো ও সাপ উভয়েই মরেছে এ খবর শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে যায়।
৫৯.
তার মা শা-জাদি এবং ইয়াসিনকে শারিবাই সুখবরটা দেয়। অবিশ্বাস্য এই প্রস্তাব ইয়াসিনকে দিশাহারা করে। হানিফ বিয়ে করতে চায় পলবিকে। সে দীর্ঘ সময় রুদ্ধবাক হয়ে থাকে। তার ভিতরে আনন্দ, বেদনা, উচ্ছ্বাস, অনেক না-বলা কথা একসঙ্গে কোলাহল করে ওঠে। সে কিছু বলতে পারে না। এইসব অনুভূতি স্তিমিত হয়ে এসে ইয়াসিনের মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভয় এসে বাসা বাঁধে। শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে তো?
কেননা তার অভিজ্ঞতায় বাজিকরদের জীবনে এ ধরনের সৌভাগ্য কখনো হয়নি। যতদিন তারা পুরোপুরি যাযাবর ছিল, ততদিন সমাজের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা তারা করেনি। এখন এই দীর্ঘদিন ধরে গৃহস্থ হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে কিছু কিছু প্রত্যাশা সে করে বটে, কিন্তু দাবি হিসাবে এখনো সে কিছুই প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কাজেই হানিফের প্রস্তাব ইয়াসিনকে খুবই বিভ্রান্ত করে দেয়।
সে বারবার শারিবাকে জিজ্ঞেস করে নিজের সংশয় দূর করতে চেষ্টা করে। বিয়ে করবে হানিফ সাহেব? আর কিছু নয়ত? এর মধ্যে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি নেই তো?
পাঁচবিবি থেকে পালিয়ে আসার সময় পলবির কারণে গভীর ক্ষতটা ছিল বুকের মধ্যে। একটা দগদগে ঘা, যা দীর্ঘকাল তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। সময়ে সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়, ঘা-ও শুকায়। জীবন এরকম স্বার্থপরই বটে। ইয়াসিন কি হাসেনি? ইয়াসিন কি স্বাভাবিক হয়ে যায়নি? সবই আবার যেমনকার তেমন বিস্মৃতিতে হারিয়ে গেছে।
তারপর পলবি যখন ফিরে আসে, ইয়াসিন দেখেছিল ঘা উপরে শুকোলেও ভিতরের ক্ষত এখনো আছে। যেন কেউ কেউ পুরানো ক্ষত আবার খুঁচিয়ে দিয়েছিল। পলবি যখন আবার কাঙালপনা শুরু করল, আর তা নিয়ে গোষ্ঠীতে সাতকথা হতে থাকে, তাতে সে দুঃখ পেয়েছিল। শা-জাদি তাকে অনুযোগ করেছে, মেয়েকে শাসন করতে বলেছে, সেসব কিছুই পারেনি। সে অনেকদিন আগে থেকেই জানত জামিরের মতো ক্ষমতাশালী মণ্ডল বা সদার সে নয়। আবার সে ভাবত, জামির অত শক্ত মানুষ হয়েও কী করল বাজিকরদের জন্য? কিন্তু তবুও তার আকাঙ্ক্ষা ছিল, ছিল প্রচুর ইচ্ছাশক্তি যা বাজিকরদের নতুন করে বাঁচতে হয়ত তৈরি করেছে। ইয়াসিন এসব পারে না। সে শুধু দুঃখ পেতে জানে। মেনেও নেয় এই সেই দুঃখ।
পলবি শুধু দুঃখ দেবে এ সে মেনেই নিয়েছিল, আর এখন শারিবার কাছ থেকে এরকম একটা প্রস্তাব শুনে সে দিশেহারা না হয়ে থাকে কী করে? হানিফ, যাকে কিসমতের অবস্থাপন্ন চাষি মুসলমানরাও কন্যা সম্প্রদান করতে পারলে বর্তে যায়, সে কিনা পলবিকে বিয়ে করতে চায়! সেই অল্পবয়সে দেখা একটি একই রকম ঘটনার কথা কি অসংখ্যবার ভাবেনি? সোজন বাজিকর ও পাখির কাহিনী বাজিকরদের কাছে উপাখ্যান হয়ে আছে। অল্পবয়সে ইয়াসিনদের কাছে সোজন ও পাখি এক বিয়োগান্ত বিষাদের আকর্ষণ। কতবার কতভাবে তারা এসব আলোচনা করেছে। সেই পাখির পরিণতিও মানুষ দেখেছে। পলবির জন্য ইয়াসিন কি এরকম কোনো পরিণতি আশঙ্কা করেনি? পাখির পচা ফুলে ওঠা শব সমস্ত যুবক বাজিকরদের চোখের সামনে চিরকাল পুকুরের জলে ভাসে।
কাজেই ইয়াসিন বিশ্বাস করতে চায় না এসব কথা। শুধু তার জীবনে কেন, সমস্ত বাজিকরের অস্তিত্বকালে এরকম অসাধারণ ঘটনা কখনো ঘটেনি। বাজিকর এতে অভ্যস্ত নয়।
পনেরো-ষোল বছর আগে একবার সরকারি লোক এসেছিল তাদের পাড়ায় লোকগণনার কাজে। তারা দেখেচ্ছিল তখন চাষিগেরস্থরা কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত কম দামে কনট্রোলের কাপড় কিনে আনত। ইয়াসিন ভেবেছিল, হয়ত কনট্রোলের কাপড় কেরোসিন ইত্যাদির জন্য সরকারি লোক নাম লিখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম একটা কথা জিজ্ঞেস করে সে সবার কাছেই বোকা হয়ে গিয়েছিল। কেননা, সবাই জানত কনট্রোলের কাপড়, কেরোসিন এসব কখনোই বাজিকরদের জন্য নয়। তারও কয়েক বছর পর আজুরা মণ্ডলের সাথে একজন নেতা এসেছিল। খুব কালো একজন প্রৌঢ় মানুষ, ভীষণ রোগা রোগা হাত পা। মানুষটার মাথায় একটা সাদা টুপি ছিল। পরে বাজিকরেরা শুনেছিল, মানুষটা একজন কংগ্রেসি নেতা। সেই মানুষটা তাদের কিছু কথা বলেছিল। তার মধ্যে কংগ্রেস, কমুনিস্ট, সোস্যালিস্ট, ভোট, গান্ধীজি এইসব শব্দ ছিল। এই শব্দগুলো বাজিকর বয়স্কদের কাছে ভীষণ অপরিচিত ছিল না, কিন্তু খুব একটা বোধগম্যও ছিল না। মানুষটি তাদের জিজ্ঞেস করেছিল, গান্ধীজির নাম তারা শুনেছে কি না।
ইয়াসিন মাথা নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ শুনেছে।
কে সে?
ইয়াসিন এর কোনো নির্ভরযোগ্য জবাব দিতে পারেনি। তেমনি অন্য শব্দগুলোর মধ্যেও কিছু কিছু চলতে ফিরতে অবশ্যই শুনেছিল তারা, কিন্তু সে সম্বন্ধে কোনো বিশেষ ধারণা তাদের ছিল না।
তখন আজুরা মণ্ডল বলেছিল, দাদা, হেথায় অপিক্ষে করে লাভ নেই। ইয়ারা হামার লোক, হামার কথা শোনে। এর আগে একবার আজুরা তাদের বুঝিয়ে ভোট দিতে নিয়ে গিয়েছিল। ইয়াসিন বোঝে এবারও সেই ভোটের ব্যাপার। হাটে বাজারে চলতে ফিরতে এমন কথাই শুনছে তারা।