সন্ধ্যার পরে হানিফকে তাঁবুতে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে শারিবার মাথায় লাঠির বাড়ি পড়ে। হয়ত আঘাত অন্ধকারে তেমন জুৎসই হয়নি। শারিবা চিৎকার করে দৌড়ায়, ঘাতকরা তার পিছনে ছোটে, আবার আঘাত করে। শারিবার চিৎকারে রাস্তা তৈরির মজুররা সোরগোল করে লাঠিসোটা নিয়ে দ্রুত এসে পড়ে। তাদের সঙ্গে হানিফ। অচৈতন্য শারিবাকে রূপার ঘরে নিয়ে আসে হানিফ।
রক্তাক্ত ও জ্ঞানহীন শারিবাকে দেখে রূপা উন্মত্ত হয়ে যায়। শারিবা তার একমাত্র জীবিত সন্তান। শরমী এখন পর্যন্ত তাকে কোনো সন্তান দিতে পারেনি। রূপা, ভয়ঙ্কর রূপা, প্রকাশ্যেই সব প্রতিজ্ঞা করে, বিষহরির নামে কিরা কাটে।
শারিবা সারারাত অচেতন থাকে। পরদিন সকালে পাথরকুচি ফেলতে আসা একটা ট্রাকে করে হানিফ তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যায়। রূপা যায় তাদের সঙ্গে ও হাসপাতালের দরজায় বসে থাকে।
ডাক্তাররা কোনো অভয় দেয় না। মাথায় আঘাত ও অচৈতন্য। জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না। রূপা পুরো দু-দিন দু-রাত অন্নজল ত্যাগ করে হাসপাতালের দরজায় বসে থাকে।
তৃতীয় দিনে শারিবার জ্ঞান ফেরে। বিহুল দৃষ্টিতে ঝাপসাভাবে সে প্রথমে দেখে রূপা ও হানিফকে। কিছুটা আশ্বাস পাওয়া যায়।
আরো তিন-চার দিন পরে শারিবা সঙ্কটমুক্ত হয়। ডাক্তারদের অভয় পেয়ে রূপা ফিরে আসে। তারপর সে আকালুকে বলে একটা মোটা বাঁশ যোগাড় করে আনতে। সে ভীষণ গম্ভীর, তার চোখে যাযাবরী আগুন।
আকালু বাঁশ নিয়ে এলে রূপা গভীর অধ্যবসায়ে কাজে লেগে যায়। আকালুকে কাছে কাছে রাখে। প্রথমে কুড়োলের পিছন দিক দিয়ে বাড়ি মেরে বাঁশটাকে ফাটিয়ে চৌচির করে সে। দরমার বেড়া বানাতে হলে যেমনভাবে বাঁশ ফাটাতে হয়, তেমনিভাবে। তারপর ধারালো কাতা দিয়ে বাঁশের ভেতরের গাঁটগুলোকে চেঁছে পরিষ্কার করে। বার বার বাঁশের ভেতরের ব্যাস মেপে দেখে সে। সবশেষে, উপকরণটি তার পছন্দ অনুযায়ী হলে পাটের সুতলি দিয়ে আগাগোড়া জড়িয়ে সে বাঁধে ওটাকে। তারপর আকালুর উপর আদেশ হয় জলা থেকে একটা সোলার টুকরো নিয়ে আসার।
আকালু সোলা আনলে বাঁশের চোঙার দু দিকে সে দুটো ছিপি মাপমতো কেটে লাগায়। তারপর একদিকের ছিপ্তি বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটা লম্বা শক্ত সুতোর সঙ্গে এমনভাবে আটকায়, যাতে বাঁশের গোড়ার দিক ধরে সুতোয় টান দিলে সামনের ছিপি খুলে চোঙার মুখ উন্মুক্ত হয়। পদ্ধতিটি বার বার পরীক্ষা করে সে সন্তুষ্ট হয় ও পূর্ণ দৃষ্টিতে আকালুর দিকে তাকায়।
আকালু রূপার বিশাল রক্তাভ চোখ দেখে ও নিমেষেই এই সমস্ত পরিকল্পনা ও তার পিছনের যাবতীয় উদ্দেশ্য তার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তার চোখ ক্রমেই বিস্ফারিত হতে থাকে।
রূপা চাপা ব্রাসে বলে, আকালু, হারামজাদা, কাইটে ফালামো, কয়া দিলাম বুঝলু?
আকালু ঘাড় নাড়ে, অর্থাৎ সে বুঝেছে। কাইটে ফালামো’, এই কথাটা কাজ শুরুর প্রথমেই রূপা শরমীকেও বলেছিল। শরমী প্রথম থেকেই বিষয়টা ধরতে পেরেছিল ও সভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, এটা হচ্ছেটা কি?
আকালুর প্রাথমিক বিহ্বল ভাবটা কেটে যাওয়ার সেও সমান উৎসাহিত হয়। তারপর রূপা বেছে বেছে একটি কঁপি বের করে। ঝাঁপির উপর দু-তিনবার টোকা দেয় সে। ঝাঁপির মুখ একটু ফাঁক করে রূপা শব্দ করে ফু দেয় দু-তিনবার। ভিতর থেকে সমান জোরে সাপ গর্জন তোলে। রূপা তারপর ঝাঁপির ঢাকনা সরিয়ে নিতে কালো বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে একটা সাপের দেহের উপরিভাগ। রূপা ডান হাত সামনে মুঠো করে ধরে সাপকে বারকয়েক দুলিয়ে বাঁ হাতে চট করে সাপের মাথা ধরে ফেলে ও সাথে সাথেই সাপের লেজ ডান হাতের আঙুলে আটকায়। বাঁশের চোঙাটা ইঙ্গিতে আনতে বলে সাপের মুখটা সে চোঙার পিছনের মুখে ঢুকিয়ে দেয়। সাপ অক্লেশে চোঙার ভিতরে ঢুকে যায়। সুতোয় টান দিয়ে এবার চোঙার সামনের ছিপি খুলে দেয় রূপা। বাঁশের উপর দু-একবার চাপড় মারতে সাপ বেরিয়ে আসে সামনের দিক থেকে। তারপর রূপা সাপকে আবার ঝাঁপিতে বন্ধ করে রাখে।
সব কাজ শেষ হলে রূপা আকালুকে আরেকবার সতর্ক করে ও বলে, সময় মতো আততাৎ ডাকি নিব, চ্যাতনে থাকিস!
তারপর এই মধ্যরাত্রির অভিযান। রূপা স্থির, কিন্তু আকালুর সর্বাঙ্গে উত্তেজনা। পাঁচিলের উপর ঘোড়ার মতো চেপে বসে দম নেয় আকালু। পরে মাচান বেয়ে উঠে আসে রূপা। দীর্ঘ বাঁশটিকে টেনে উপরে তোলে সে। আকালু বাঁশ হাতে নিয়ে ভিতরের গাছের ডালের উপর উঠে পড়ে। একটা নির্দিষ্ট ডালে সে অবলীলায় এগোতে থাকে। রূপা পাঁচিলে বসে নজর রাখে। আকালুর ডালটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে একটু চেষ্টাতেই সে ভায়রোর গোলাঘরের চালায় উঠে পড়ে। টিনের চালায় মাটির দোতলা বাড়ি।
গোলার চালা বেয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে আকালু দোতালার একটা জানলা ধরে ফেলে। আবছা চাঁদ আকাশেপর্কেট থেকে রূপার দেওয়া টর্চ বের করে সে। পাকা কাজ রূপার। টর্চের আলোয় দেখা যায় হাতদশেক দূরে ভায়রোর মশারি ঢাকা বিছানা। এসব হিসাব রূপা আগে থাককেই রেখেছিল। এখন ধীরে ধীরে জানলা দিয়ে বাঁশটা বিছানায় ঢোকায় আকালু। হাত কাঁপে তার। বাতানো মশারী বাঁশ দিয়ে সরানো মুশকিল। একমাত্র নির্ভরতা ভায়রোর প্রচণ্ড নাকের গর্জন। বড় খাট, মশারি ফঁকা করতে অসুবিধা হয় না আকালুর। তারপর সুতোর টানে ছিপি খুলে বাঁশের উপর আলতো চাপড় মারে সে। বাঁশ হালকা হয়ে যায়। আন্দাজে বাঁশ দিয়ে একটা খোঁচা মারে সে সাপকে। সাপের ক্রুদ্ধ গর্জন দশ হাত দুর থেকেও সে পরিষ্কার শোনে।