ফলে এস. ডি. ও-কে একদিন তদন্তে আসতে হয়। ভোটের আগে, বিশেষ করে সাতষট্টির ভোটের আগে, প্রশাসন যেমন চতুর নিরপেক্ষতা নেয়, তদন্ত রিপোের্টও তেমনি হয়।
সুতরাং ভায়রো, আজুরা কিংবা অঞ্চলের বামুন-কায়েতদের উপলক্ষ্য তৈরি করা ছাড়া উপায় থাকে না। প্রথমে বাজিকরদের মজুরের কাজ দেওয়া বন্ধ হয়। কিন্তু সেখানে হাজিসাহেবের দলবল যথেষ্ট উদারতা আগে থেকেই দেখাতে শুরু করেছে।
যখন আর কিছুই হাতে থাকে না, তখন তোর বাবা জল ঘোলা করেছে’ থাকে। কিন্তু বাজিকর স্ত্রী-পুরুষ হঠাৎ নিজেদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে সহজেই আর ব্যাপারগুলো মেনে নিচ্ছে না। তাছাড়া যাযাবর জাত হিসাবে তাদের স্বাভাবিক উপস্থিত কূটবুদ্ধির তুলনা নেই।
সেই সময় মহিন নমোশূদ্রপাড়ায় মুরগি চুরি করে ধরা পড়ে ও তার সমুচিত শিক্ষা পায়।
ক্রোধে ক্ষোভে দিশাহারা ইয়াসিন পাঁজাকোলে মহিনকে কোলে তুলে নিয়ে ভায়রোর দাওয়ায় শুইয়ে দেয়। মহিন রক্তাক্ত, অচৈতন্য।
ইয়াসিন বাজপাখির মতো যাযাবরী চোখে তাকায় ভায়রোর দিকে। মুখে বলে, মালিক এলা কি বিচার?
তার পিছনে বাজিকরপাড়ার অর্ধেক মানুষ। ভায়রোর চোখ ঘোরে। ক্রোধে রক্তবর্ণ চোখ। এত সাহস!
মুখে বলে, চোরের বিচার। তা এঠি নিয়া আসিছিস ক্যান?
ইয়াসিন বলে, তুমু দশের মাথা, দিগরের মাথা। ক্ষেতি কিছু হামার বেটা করে, জরিমানা দিমো। কেন্তু দশবছুরা চ্যাংড়ার উপর ইকী অবিচার?
ছেষট্টি সালেও ভায়রোর কাছে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা। ভিখ-মাঙ্গা বাজিকর সোজা চোখে তাকিয়ে বিচার চায়! সারাদেহে কম্প ওঠে তার, খোঁপা খুলে গিয়ে ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়ে। ভায়রো আওয়াজ তোলে, যে আওয়াজে গোয়ালের গাই পাল ঝেড়ে ফেলে, এমন জনশ্রুতি। আয়রো সেরকম আওয়াজ তোলে। আজ তার তেজারতির সেই বিশাল সাজ্য নেই, নেই অফুরন্ত ধানের উৎস জমি। বিভিন্ন কারণে এসব তার কমিয়ে আনতে হয়েছে, করতে হয়েছে নানা ঢাকচাপ গোপন বন্দোবস্ত। কিন্তু এখনো তার দিগর আছে, আছে তাকে জড়িয়ে ক্ষমতার নানা কিংবদন্তি।
তার লোকজন তৈরিই ছিল। তারা কয়েক পা এগিয়ে আসে।
ভায়রো দ্বিতীয়বার কিছু আদেশ দেবার আগে হঠাৎ শারিবা এগিয়ে আসে। কেমন নির্ভীক অকুতোভয় শারিবা। বলে, মালিক হামারও এটা নালিশ আছে। ওমর নামে আমাদের জুয়াটা কেংকা হাওয়া হেই গেল, সিটা আমি স্বচক্ষে দেখিছিলাম।
শারিবা সোজা তাকিয়ে থাকে ভায়রোর চোখে। ভায়রো স্তব্ধ, ভীষণ। বলে, দেখিছিলা? মোনে আছে?
শারিবা আর কোনো কথা বলে না, নিচু হয়ে মহিনকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। ইয়াসিনকে বলে, ওঠেক মামা। মালিকের কাছে বিচার নাই।
ভায়রোর কাছে এ সমস্তই অসহ্য। অপমানকর। এখন যদি এত সাহস হয়, আর কদিন পরে কী অবস্থা হবে? সে আবার গর্জন করে এবং সমবেত নমোশূদ্রদের কিছু আদেশ করে।
অনেকগুলো উল্লসিত কণ্ঠে পেশাদারি হামলার আওয়াজ ওঠে—‘মারো শালোদের’ ‘খুন করি ফালামো’। কয়েকজন লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে আসে।
পাঁজাকোলে মহিনকে নিয়ে শারিবা সবার সামনে। স্বতন্ত্র যাযাবরী বৈশিষ্ট্যে সে চেহারা অনেক বেশি আকর্ষণ দাবি করে। সবার উপরে চিৎকার করে শারিবা বলে, থামেন তুমরা, থামেন! কথা শুনেন হামার!
যেসব বাজিকরেরা ছুটে পালাচ্ছিল তারাও থমকে দাঁড়ায়। শারিবা বলে, আজ বাদে কালই মানুষগুলা মোছলমান হবে সেলা তুমরা জানেন? আজই মানুষগুলার মাথাৎ ডাং মারলে, কাল সারা থানায় আগুন জ্বলি উঠবার পারে, কি উঠবেই। হাজিসাহেবের ভাগ্না হকসাহেব হেথায় হাজির আছেন, তাকে তুমরা না চিনেন তুমাদের মালিক চিনেন। দাঙ্গার আগুন কি জিনিস, তুমরা জানেন। তাৎ কার ঘর পুড়ে, আর কার মাথা ভাঙ্গে, আর কার বইন-বিটির ইজ্জত লুট হয়, সি তুমাদের দেখা আছে। ই মানুষগুলা তুমাদের সাথ দাঙ্গা করবা আসে নাই, আসিছিল মালিকের কাছে বিচার চাইতে। কিন্তু মালিকের বিচার নাই। ই মানুষগুলা যাবার দেন।
শারিবা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে। অন্যেরা তাকে অনুসরণ করে। প্রতিপক্ষ কী এক দ্বিধায় কর্তব্য স্থির করতে পারে না। বাজিকরেরা চোখের আড়াল হয়ে যায়।
৫৮.
মহরমের তিন দিন আগে গভীর রাতে ভায়রোর বাড়ির পিছনে দু-টি ছায়া কী যেন চক্রান্তে অস্থির হয়ে ওঠে। দু-টি নিঃশব্দ ছায়া মাত্র। একজন বলিষ্ঠ দীর্ঘদেহী, অন্যজন ক্ষীণাঙ্গ কিন্তু অত্যন্ত ক্ষিপ্র।
একটা চাকা-খোলা গরুর গাড়ির মাচান, যা যে-কোনো গৃহস্থের উঠানেই পড়ে থাকে, এনে মাটির উঁচু পাঁচিলের সঙ্গে মইয়ের মতো দাঁড় করিয়ে দেয় তারা। বলিষ্ঠ ব্যক্তির হাতে একটা মোটা বাঁশ, যার দৈর্ঘ্য হাত পনেরো হবে। যদি ভালো করে দেখা সম্ভব হতো তাহলে দেখা যেত বাঁশটি নিপুণ মসৃণ।
ক্ষিপ্র ব্যক্তি মাচানের মই বেয়ে পাঁচিলের উপর উঠে দুই পাশে পা ঝুলিয়ে সওয়ার হয়ে বসে। স্থানটি তারা নির্বাচন করেছে একটা গাছের অন্ধকার নিচে। পাঁচিলের উপরে বসা ব্যক্তি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভিতরের সব কিছু দেখতে থাকে।
কেননা শারিবা একদল মারমুখী মানুষকে ভয়ঙ্কর একটা পরিণতির অশুভ ও নির্বোধ দিক দেখাতে সমর্থ হলেও, একজন কিংবা দু-জন অন্ধকারে এগিয়ে আসা ঘাতককে আটকাতে পারেনি। ভায়রো সম্পূর্ণ বিষয়টি তার পরাজয় ও দিগরপতি হিসাবে অপমানকর বলেই গ্রহণ করেছিল। এই ঘটনার কোনো পূর্ব নজির নেই, তার ষাট বছরের জীবনে এ অত্যন্ত নতুন ও ভীষণ।