এখন আর এরকম মনে হয় না। এখন মনে হয় যে তার বাপ ছিল একজন নির্ভেজাল মানুষ। যেমন গাই-বলদের মুখের মধ্যে একবার হাত ঢুকিয়েই যে তাদের নির্ভুল বয়স বলে দিতে পারত, তেমনি ব্যক্তিজীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তার ধারণাগুলোকে অতি দ্রুত সিদ্ধান্তে আনতে পারত সে। এতে তার বিশেষ ভুলও হতো না। কাজেই দাঙ্গার গল্পে যে অর্থ বিভ্রান্ত হয়নি। আবার ওপারে গেলে অনেক বেশি জমি পাবে তার এখানকার অল্প জমির পরিবর্তে, এই লোভের ফাদেও সে পা দেয়নি! শুধু সেইসব অবিশ্বাস্য ঘটনা সংঘটনের দিনে যখন তখন বিরক্ত হয়ে উঠত আর বিড়বিড় করত—জানোয়ার সব, সব জানোয়ার!
অথচ সে ছিল এক নিষ্ঠাবান মুসলমান। নিয়মিত গরুর জাবনা দেওয়া, মাঠে হাল নামানো ও নামাজ পড়া, এই তিন কাজের কোনোটার গুরুত্বই তার কাছে কম ছিল না। আবার দেখ, সেই মানুষটা যখন পেটের শূল ব্যথায় মরে, তার আগে হানিফকে বলেছিল, দেখ হানিফ, কেউ যদি বলে, তুমি হারাম খাও তবে তোমার ই বেথা কমবে, তবে তাই খাই! তবে তাই খাই!
সুতরাং বিজয়বাবু, মতিবাবু কিংবা শহিদুল ভাই নয়—হানিফ এখন বোঝে সেই মরা বাপ এখনো তার বিবেকের উপরে পাহারা দেয়, অথবা সেই বাপ তাকে যা দিয়ে গেছে তাই সত্য, আর কিছু নয়।
তারপর আবার তার ঘুম আসে। ঘুমের মধ্যে হানিফ রোলার চালায়।
৫৭.
ইংরেজি ছেষট্টি সালে এ অঞ্চলে অস্পষ্ট দুর্ভিক্ষ যেন। আশ্বিন-কার্তিকের অভাব এমনই তো, আবার এমন কখনো নয়। একথা গ্রামের মানুষের কাছে প্রতিবছরই মনে হয়। বাজিকর রমণীদের আমানির বাটি ফুল্লরার গর্তের মতোই অকরুণ! এখন প্রত্যেকের দৃষ্টি কার্তিকের মহরমের দিনটির প্রতি। কি এক পরিত্রাণ যেন সেই দিনটি নিয়ে আসবে। কেননা এ সময়ের একমাত্র আশা পাট অতিবৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিনষ্ট।
প্যাটের সঙ্গে বাজিকরের সম্পর্ক কি? তাদের জমি না থাকলেও পাট গরিবের বড় সহায়। পাট পচানো ও পাট ধোয়ার ভীষণ কষ্টসাধ্য কাজটা এ সময়ে তার এক কাজ। সারাদিন ভাদ্র-আশ্বিনের গুমোট গরম ও চড়া রোদের মধ্যে কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে পাট ধুতে হয়। আর সেই বিষাক্ত পচা জলে না আছে কি? কিন্তু এবার সে কাজ নেই। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বৈশাখ থেকেই, নাগাড়ে বৃষ্টি। পাট-চারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘাস বেড়েছে, খেতের মাটিতে সারা সময়টাই ছিল থকথকে কাদা। কাজেই পাট নিড়ানির কাজের সময়ও মার খেয়েছে জল-পাট, এখন শুধু মহরমের দিনটির জন্য পেটের ক্ষুধা ও বুকের আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করা।
কিন্তু শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা ভবিষ্যতের জন্য এভাবে বুক বাঁধতে রাজি নয়। যে-কোনো মূল্যে ক্ষুন্নিবৃত্তির বন্দোবস্ত তারা করে যায়, তোক সে চুরি, ভিক্ষা বা অন্য কোনোরকম অস্বাভাবিক উপায়।
মুরগি চুরি করতে গিয়ে শা-জাদির দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান মহিন ধরা পড়ে যায় নমোশূদ্রপাড়ায়। এ সময় গেরস্থরা সজাগ থাকে। তাছাড়া মহরমের দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও অঞ্চলে গোপন ছিল না।
ইয়াসিনের নমোশূদ্র সমাজে অন্তর্ভূক্তির আবদারে যদিও ভায়রোর কিছু করার ছিল না, তবুও বাজিকরদের সদলে মুসলমান হওয়ার পরিকল্পনায় আর দশজন হিন্দুর মতোই সে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বামুন-কায়েতরা এ বিষয়ে পরামর্শ করতে তার কাছেই আসে। কিন্তু শক্তিশালী ভায়রোও একেবারে দরজার সামনে দাঁড়ানো বিপদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থার বিধান দিতে পারছে না। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভারসাম্য আছে, বাজিকরদের সদলে মুসলমান হওয়ার ঘটনায় তা ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হবে। এতে সবাই চিন্তিত। সবচেয়ে বড় কথা, রেশারেশিতে হাজিসাহেবের দলবল জিতে যাচ্ছে, এর থেকে অপমানকর উত্তেজনা ভায়রোদের কাছে আর কি আছে?
খবরটা শেষপর্যন্ত শহরে গিয়েও পৌঁছায়। সাতষট্টির নির্বাচনের ডামাড়োল তখন শুরু হয়ে গেছে। সর্বত্র চরম অবস্থা ও বিশৃঙ্খলা। সামগ্রিক বিচারে থানায় এই মুহূর্তে কোন্ সম্প্রদায় অধিক, তা বলা কঠিন। কিন্তু বিধানসভার আসনটি তপশীল জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। কাজেই শহরের রাজনৈতিক নেতারা এই মুহূর্তে মুসলমান সমাজকে চটাতে কোনোরকমেই রাজি নয়। কিন্তু সঙ্কট উভয়ত। সরকারি হিসাবে যেহেতু এককভাবে তপশীল জাতি ও উপজাতির স্থান এ থানায় প্রথম, রাজনৈতিক নেতারা তাদের তুষ্ট করার জন্য সবচেয়ে বেশি ভাবেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক কারণে ভোটের যে ভাগাভাগি হয়, তাতে মুসলমান সমাজকে উপেক্ষা করলে ভরাডুবি হবার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। কেননা মুসলমানের সংখ্যা এ থানায় তপশীল জাতির পরেই এবং জয়-পরাজয়ের নির্ধারক বিন্দুটি তাদের ভোটেই স্থিরীকৃত হয়। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। বিষয়টির সমর্থন কিংবা বিরোধিতা উভয় ঘটনাই যে এবার নির্বাচনে ব্যাপক ভূমিক্ষয় ঘটাবে এ বিষয়ে কারো কোনো সংশয় থাকে না।
অথচ এ ঘটনা নিয়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না। ভায়রো তার সদরের উকিলবাবুকে দিয়ে বয়ান লিখিয়ে স্থানীয় অবস্থাপন্ন ও প্রতিপত্তিশালী হিন্দুদের দিয়ে সই করায় ও প্রশাসনের কাছে প্রতিকার দাবি করে। তাদের অভিযোগ, জোর করে ও লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তকরণ সনাতন ধর্মের প্রতি অবমাননা।
এর পাল্টা হাজিসাহেবের ভাগ্নে মালদা জেলা কোর্টের অত্যন্ত প্রভাবশালী জনৈক আমিনুল হক ছুটি নিয়ে এসে বাদা-কিসমতের আসর জমিয়ে বসে।