দয়ারামের সেই ভৃত্য যে নিজের ঘাড় পেতে দেয় প্রভুকে ঘোড়ায় উঠতে সাহায্য করার জন্য এবং সালমার নতুন পরিচিত সেই ক্রীতদাসী রমণী যাকে প্রতিরাতে আবিষ্কার করতে হয় তার প্রভুকে উত্তেজিত করবার পদ্ধতি, অথবা রাজমহল বাজারের গোলাদার, মহাজনের ঘরে ঘরে ঋণজালে আবদ্ধ কৃষ্ণকায় সাঁওতাল, অথবা সাহেবগঞ্জের রেলের রাস্তা পাতার কাজে নিযুক্ত শয়ে শয়ে কুলি—যারা কঠিন প্রহরায় পালাতে পর্যন্ত সাহস করে না ও অজ্ঞাত এক জ্বরের প্রকোপে মরে।
আবার দেখ, আদিম রক্ষণশীলতায় সমস্ত সামাজিক বন্ধনহীন বাজিকরও নিয়মবদ্ধ থাকে। যেমন সালমা আর পীতেমের পরিণতি।
এই যাবতীয় বিভ্রান্তির বিষয় পীতেমকে পীড়িত করে। শেষবারের মতো আসার আগে নানা একবার তার বাপের সঙ্গে এদেশে এসেছিল। সে সম্ভবত তার শৈশব কিংবা কৈশোরের কথা, এখন থেকে ষাট-সত্তর বছর আগের ঘটনাই হবে। সেবার বাজিকরের দল এখান থেকে পালিয়েছিল। কেননা তারা দেখেছিল মানুষ তখন যেভাবে মরে, তাতে পতঙ্গের মৃত্যুর মর্যাদাও সে পায়নি। অথচ, সেই মানুষই ফসল ফলিয়েছিল, যে যার নির্দিষ্ট নিয়মমতো শ্রম দিয়েছিল। আর সেইসব মানুষ, যারা এইসব শ্রমদায়ী মানুষের সর্বস্ব লুঠ করেছিল, তাদের মতো হৃদয়হীন যন্ত্র বাজিকর সমস্ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়বার দেখেনি। দেখতে চায় না। কে তখন বাজিকরের ভান্মতি দেখবে? তখন বাজিকর দেখেছে খাজনা না দিতে পারার জন্য গাছে ঝোলানো মানুষ, চুনের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ মানুষ, বিষ্ঠা ভক্ষণে বাধ্য মানুষ, বস্তাবন্দী জলমগ্ন মানুষ, আরো অসংখ্য অশ্লীল কদাচার যার নাম শাস্তি, যার নাম প্রজাকে শায়েস্তা করা। পৃথিবীর যাবতীয় ইন্দ্রজাল কিংবা ভানুমতির খে থেকে অনেক বেশি উত্তেজক ও বিস্ময় উদ্রেককারী এইসব ঘটনা। তখন পীতেমের নানার নানা বলেছিল, এ দেশের মানুষগুলোকে অবশ্যই দানোয় পেয়েছে, না হলে এমন হয় না, সুতরাং পালাও এখান থেকে।
আবার বাপ না বলল তাকে পূবের দেশে যাও, পীতেম?
পুবের দেশে জল আছে, ফল আছে, মানুষ আছে, জানোয়ার আছে।
তবে যে নানা বলেছিল, সেখানে দুর্ভিক্ষে আধা মানুষ মরে যায়?
আধ মানুষ থাকে, তারা আবার নতুন মানুষ বানায়।
কিন্তু আমার ভান্মতি দেখে কে? কে দেখে ভালুক আর বাঁদরের নাচ? কে কেনে সালমার ভবিষ্যৎবাণী? টোটকা, মাদুলি, কুহক বিদ্যা?
দৈত্যের মতো রেলের গাড়ি ভীষণ গতিতে শ’য়ে শ’য়ে মাইল ছুটে যায়। জলের উপর দিয়ে অতবড় লোহার নৌকো মালবোঝাই হয়ে দ্রুত এগোয়। টেলিগ্রাফের তার শহর ছেড়ে গ্রাম পেরিয়ে নতুন শহরের দিকে ছোটে।
বাপ, হে বাপ, আমার সওদা কে নেবে?
অত সময়ও নেই মানুষের। সাহেবরা নিত্য নতুন উত্তেজনার আমদানি করছে। সদাচঞ্চল, সদাকর্মব্যস্ত মানুষ। কেউ কি দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে বাজিকরনির নাচ দেখবে? দেখবে কি ঘাঘরার উপরে কাচ আর পুঁতির কারুকার্য?
দেখ, সালমা, কেউ তোকে না বাঁধলেও তুই বাঁধা পড়বি। যেন সারা দুনিয়া জুড়ে ফঁদ পাতা। সেই ফাঁদে অজস্র ফঁাক, তবু তুমি যেতে পারবে না, এমনই মজা। তোমাকে থাকতেও কেউ বলে না, যেতেও কেউ বলে না। মানুষ শুধু দুঃখ পায়।
সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায় পীতেমের। অতি পরিচিত এবং অপরিচিত সমাজ, নিয়মশৃঙ্খলা, লোভ, পাপ, ক্ষুধা, ঘাম, রক্ত, ব্যক্তি, গোষ্ঠী কোন নিয়মে চলে! কেনই বা চলে! এসব বাজিকর বুঝতে চায় না, বোঝার দরকারও বোধ করে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিহাসের মতো যে বিষয় তা হল, বাজিকরের অস্তিত্ব নির্ভর করে যেসব মানুষের উপর তারা বাজিকর নয়। তারা সব যুথবদ্ধ, শ্রেণীবদ্ধ, আপন আপন অঙ্গীকারে বদ্ধ মনুষ্যকুল। সেই মানুষের সময় আর অঞ্জ? নয়, সেই মানুষের উপকরণ আর যথেষ্ট নয়। যে মানুষ সারাদিনের শ্রমে শুধু অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে তার অপরিহার্য বিষয়গুলো স্পষ্ট। কিন্তু যার গুদামে মালের পাহাড়, যার সিন্দুকে টাকার উপরের চাপে নিচের অংশের ধাতব বিকৃতি হয়, তার অভাববোধ অস্পষ্ট অথচ বাস্তব। আর এই যাবতীয় বিষয়ই এখন সমাজগ্রাহ্য নিয়মের অংশ।
এই নিয়মকেই যত ভয় পীতেমের। দেবতার অভিশাপে শিকড়হীন জীবনে অভ্যস্ত বাজিকর এখন সবদিকে বিস্তারী এক বৃক্ষের অজস্র শিকড়কে ঝুরির মতো নেমে পথরোধ করতে দেখে। যার বাইরে তার অস্তিত্ব বিপন্ন এবং ভিতরে অনিশ্চিত। সেজন্যই সম্ভবত সে শুনেছিল তার বাপকে বলতে, পীতেম হে, পুবের দেশে যাও।
০৫.
এইভাবে শীত পার হয়ে সূর্য উত্তপ্ত হতে থাকে। গঙ্গার পাড়ের বালি হল্কা হাওয়ায় দিগ্বিদিকে উড়তে থাকে। তারপর ক্রমশ গঙ্গার উপরে হঠাৎ হঠাৎ টুকরো মেঘের আবির্ভাব হয় এবং অচিরে তা ঝঞ্ঝার আকাশে ফেটে পড়ে, তাঁবুগুলোকে ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়।
একসময় সবাই বোঝে গঙ্গাপাড়ে থাকা সম্ভব নয়। তখন পীতেম শহরের সংলগ্ন মাঠে তাঁবু ফেলে। তার জন্য আবার দারোগার অনুমতি নিতে হয়।
হাটে ও বাজারে এবারে শীতের মাঝ থেকেই অপর্যাপ্ত শস্য আসতে শুরু করেছে। সেইসব পণ্য বৃহদাকার জলযানে ও রেলগাড়িতে চেপে যায় মুর্শিদাবাদ, সিউড়ি ও কলকাতা নামক শহরগুলোতে। এই সময় হাটবাজার প্রাণবন্ত হয়।
এইসব প্রাণবন্ত হাটে পীতেমের দল বাঁদর ও ভালুক নাচায়, রহু চণ্ডালের হাড়ের ভেলকি দেখায়, বাঁশবাজি, দড়িবাজি দেখায়। কিন্তু সবাই টের পায় মানুষ আর আগের মতো বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায় না। বাজিকর রমণীরা চলতে ফিরতে বিচিত্র হিল্লোল এবং কটাক্ষ ছুঁড়ে যেসব পুরুষকে ঘায়েল করে—যা তাদের স্বভাবের অঙ্গ, যা সৎ-অসৎ কিংবা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে না—সেইসব মানুষেরা কেউ কেউ বলদর্পী ও বেপরোয়া। কখনো কখনো তারা হামলা করে। তাতে কিছু অশান্তি হয় এবং পীতেমকে দলের মধ্যে কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রবর্তন করতে হয়, যা একান্তই নতুন।