এটা গোপন কথা কহি, হানিফ ভাই। মহরমের দিন বাজিকরপাড়ার তিন ভাগ মানুষ মোছলমান হবে।
কী?
হাঁ। আপনার মালদা থিকা মোগ্লা এবেন। বাদা-কিসমতের মসজিদে কলমা পড়া হবে। তা-বাদে একত্তরে খানাপিনা হবে।
তোমরা মোছলমান হবা?
তিন ভাগ ঘর বাজিকর মোছলমান হবে, এক ভাগ ঘর হবে না।
তুমি কোন্ দলে?
এক ভাগের দলে।
এ বুদ্ধি কার?
বিপদের, পেয়োজনের।
হানিফ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে গুম হয়ে। শেষে আবার বলে, তুমি ক্যান হবা না?
হামার বাপ নিজেরে হিন্দু ভাবে। তুমি কী ভাব? হামি ভাবি বাজিকরের কোনো জাত নাই।
হানিফ আবার চুপ হয়ে যায়। শারিবা বলে, পলবিরে যদি সত্যিই আপনি সাদি করেন তবিতো জাতের সমস্যা আর থাকল না।
হাঁ, তা থাকে না বটে—তবে আমার বিচার শোন, হিন্দু মুসলমান বেবাক জাত যদি বাজিকরের মতন, মনে কর, বেজাত হয়া যায়, তবে সিটাই ভালো হতো।
শারিবা বলে, যাক সি কথা। তবি কথাটা গোপন রাখেন। পলবির ফয়সালা আগে করি।
কর।
হামি কই, আপনে দু-চারদিন আরো ভাবেন। নিজে ভালো করি বুঝ করেন নিজের সাথ। তা-বাদে কথাৎ আগান।
হানিফ একটু ভেবে বলে, বেশ তেমনি কর। কিন্তু শারিবা, আমি তোমাদের মোছলমান হবার কথা ভাবতেছি। এতে কি বা লাভ হবে? হিঁদুরই বা কী লাভ? মোছলমানেরই কী লাভ? আর বাজিকরেরই বা কী লাভ?
মোছলমানের লাভ হাজিসাহেব জানে। হিদুর লাভ জানি না। কেন্তু বাজিকরের লাভ আছে।
আছে?
নাই! বাজিকর যবে থিকা থিতু হাওয়ার বান্না করল, তবে থিকাই সে সমাজের মানুষের কাছে আপন হবার চায়। কেউ তা আপন করে না। আজ যদি হাজিসাহেব তা আপন করার চায় তো সি যাবে না?
তুমি ঠিক জানো, হাজিসাহেব তোমাদের আপন করবা চায়?
মোছলমান তো করবা চায়।
মোছলমান করলে তোমরা থিতু হবার পারবা?
হামার নানি বুড়ি বলত, শারিবা, পিত্তিপুরুষের পাপে বেবাক বাজিকর ঘরছাড়া। অভ্যাসে ঘর তারে আর টানে না। কারণ কী, পথেই তার সব, জনম মরণ হাসি কাঁদা। শয় শয় বছর এংকাই চলি গেল। তা-বাদে দুনিয়ার রাস্তা এক দিন শ্যাষ হয়া গেল। রাস্তাৎ আর সুখ নাই, স্বস্তি নাই। পথে বিপদ আগেও আছিল, বাদে তা হোল সীমাছাড়া। সমাজের মানূষে নানা কারণে বাজিকর বাদিয়াকে ছিড়া খায়। তাই আজ তিন-চার পুরুষ ধর হামরা থিতু হবার চাছি। কেন্তু থিতু হবার আগেই বাজিকর থিতু হবার পারে না। কারণ কী, তার কি ধরম নাই।
ধরম থাকলিই তুমরা থিতু হবার পারবা?
বাজিকরের কাছে হানিফ ভাই, আইজের দিনটা সব থিকা বড় কথা এখুন পয্যন্ত। আইজকার দিনেৎ হামি মোছলমান হয়া বাঁচব। ইয়ার বেশি কেছু জানা aiz
বাঁচার রাস্তা ইটাও লয়, শারিবা। আমার সাথ শহর চল, বাঁচার রাস্তা তোমারে দেখায়া দেব।
নি যাবেন হানিফ ভাই, হামারে শহরেৎ নি যাবেন?
যাব। কিন্তু থাকতে পারবা সেথায়? তোমরা গেরামের ছেলা।
খুব পারমো। আপনার জল তুলা দিমো, পাক করি দিমো!
তবে পলবি করবো কি?
অ্যাঁ! ওঃ হো হো, সিটা তো ভুলেন না!
হাঁ, সিটা ভুলি না, সিটাই ঠিক।
৫৬-৬০. খাটিয়ায় শুয়ে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে
খাটিয়ায় শুয়ে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে একফালি চাঁদ দেখে হানিফ। নিঃসঙ্গ মানুষ প্রকৃতি থেকেও যে সুখ পায়, এমন নয়। সারাদিন যে মানুষ কাজের ভিড়ে অন্য অনেকের মাঝখানে থাকে, রাত হলে তার নিজের কথা মনে পড়ে। তখন সে পর্দা সরিয়ে চাঁদ দেখে, চাঁদ না থাকলে অন্ধকার আকাশের তারা আর ছায়াপথ দেখে হয়ত আরো একাকী হয়ে যায়।
তখন তার দাঙ্গার কথা মনে হয়, মা ও ভাইয়ের মৃত্যুর কথা মনে হয়, মনে হয় বোনের নিখোঁজ হওয়ার কথা। তখন চাঁদ থেকে হিম ঝরে, তারা থেকে বরফের কণা যেন ছিটকে এসে তার গায়ে লাগে। আলো কিংবা অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ যদি কোনো পেঁচা ঝাঁপিয়ে পড়ে মাঠের আলে, কর্কশ চিৎকার করে, তখন তার চমক ভাঙতে পারে।
কিন্তু চাঁদ তাকে আবিষ্ট রাখে। সে আয়নার খাঁড়িতে দেখা জলপরির কথা ভাবে। ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত সব পরিকল্পনা করতে থাকে সে, যা তার আয়ত্তের এবং সামর্থ্যের বাইরে। পলবির কথা ভাবতে তার ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তার বিষণ্ণ মুখ, তার চিবুকের উপরের উল্কি। একসময় নিজের অজান্তেই সে ঘুমিয়ে পড়ে তারপুর
ঘুম ভেঙে গেলে অন্ধকারে নিজেকে মনে হয় ছায়ার শরীর। এতক্ষণ অন্য কোনো জগতেই সে ছিল। আদিনার মিনা করা সুসজ্জিত মসজিদ, তার পিছনে উঁচু এবং চওড়া মাটির জাঙ্গাল। মসজিদের উপর চঁদ। কোনো মানে হয়? ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের ছবি।
সেই জাঙ্গাল, যার অবস্থিতি এখন প্রশস্ত ধানখেত, আর মাঝে মাঝে অকারণ মাটির টিলা, সেই জাঙ্গালই তো! একজন ঘোড়সওয়ার, সে হানিফ নয় কিছুতেই অথচ হানিফ ছাড়া আর কে-ই বা? পাশে যে ইরানি বেদেনি-হলুদ রুমালে বাঁধা চুল, সে তো পলবি নয়। কি আশ্চর্য, স্বপ্ন এমনই বিস্ময়! পলবিই বটে! আদিনার ধ্বংসস্তুপ কোন্ মায়াবলে হয়ে যায় সুসজ্জিত মিনার। দুই ঘোড়া পাশাপাশি হাঁটে, দুই সওয়ারে প্রাণবন্ত প্রেমের সংলাপ বলে।
তারপর উল্টোদিক থেকে ঘড় ঘড় শব্দ আসে। অশ্বারূঢ় হানিফ দেখে জাঙ্গালের উপর দিয়ে রোড রোলার আসছে। খাকি শার্ট, খাকি প্যান্ট পরা ড্রাইভার তো হানিফই বটে। মাডগার্ডের উপর আড় হয়ে বসে কে ও? পলবি? নীলের উপরে সাদা ডুরে পালপাড়ার তাঁতের শাড়ি পরে গেরস্থ মেয়েটি।
ঘুম ভেঙে যায় তার। কী যে মানে হয় এসব স্বপ্নের! তবু দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে ভেসে থাকে বিষণ্ণ ভালো লাগা। বার বার মনে আসে খুন হওয়া মা আর ভাই, নিখোঁজ বোনের কথা। অথচ বাজিকরেরা মুসলমান হবে শুনে সে কেন উল্লসিত বোধ করে না? সে কি এইজন্য যে সে হাজারে হাজারে ছিন্নমূল মানুষকে ওপার থেকে এপারে আসতে দেখেছে? অথবা, সে কি এইজন্য যে শহরের বিজনবাবু, মতিবাবু, শহিদুল ভাই তাকে কিছু বই পড়িয়েছে, কিছু কাণ্ডজ্ঞান দিয়েছে?