জলে ডুব দিতে গিয়ে পলবি খেলা পেয়ে যায়। কাপড়ের মধ্যে ঢুকে থাকা হাওয়া বেলুনের মতো ফুলে ওঠে জলের চাপে। পলবি থাবড়ে থাবড়ে সেই হাওয়ার বেলুন ফাটায়। তার যা বয়স, তাতে এ ধরনের ছেলেমানুষি মানায় না। কিন্তু এই নির্জন খাঁড়ির ঘাটে কেইবা দেখে। সব বয়সের মানুষেরই পুতুলখেলা থাকে। সব বয়সের মানুষেরই থাকে নির্ভার মধুর অথবা বেদনার শিশুসুলভ একাকিত্ব। সেখানে সে নিজের সঙ্গে কথা বলে, নিজের সঙ্গে খেলে।
হানিফ একটু আড়ালে সরে আসে, আবার চুরি করে দেখে। লোভ সামলাতে পারে না। পলবি ডুব দেয়, গা মাজে, উদ্দেশ্যহীনভাবে একদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে। তার পুষ্ট ঠোঁটে একটু বাঁকা শিহরণ বয়ে যায়, অথচ তার চোখ থাকে বিষণ্ণ। হানিফের কাছে মনে হয়, মেয়েটি হাসতে গিয়ে হাসতে পারল না। সেইসময় সে মেয়েটির নিচের ঠোঁটের নিচে চিবুকের উপর দিকে একটি উল্কি দেখে। মেয়েটি কোনো একটা বিশেষ চিন্তায় অবশ্যই বিভোর। হানিফ আবার চোখ ফেরায় ও পরক্ষণেই ফিরে তাকায়। শরীরের ভার একটু ছেড়ে দেওয়া গোছের হলেও ভীষণ আকর্ষণ করে হানিফকে। কেন যেন হঠাৎ মনে হয়, এরকমই একজনকে খুঁজছিলাম।
পলবি শেষবারের মতো ডুব দিয়ে উঠে আসে। হানিফ এবার পিছন ফিরে দাঁড়ায়। পলবি যতটা সম্ভব কাপড়ের জল হাত দিয়ে চিপে এগিয়ে আসে।
হানিফ বলে, মাফ করবেন, আপনার গোসলের সময় না বুঝে এসে পড়েছিলাম। গলায় কিছুটা শহুরে সৌজন্য আনার চেষ্টা করে সে।
পলবি থেমে যায়। পুরুষমানুষ তার কাছে নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু জীবনে সে এই প্রথম শুনল ‘আপনি’ সম্বোধন এবং ‘মাফ করবেন। সে ভীষণ লজ্জা পায়। যতটা সম্ভব ভিজা কাপড় টেনে গা ঢাকে সে। বলে, তাৎ কি হয়াছে, ইটা তো সোব্বারই গোসল করার জায়গা। আপনি তো হামরাদের শারিবার বন্ধু হানিফ সাহেব?
হানিফ খুব অবাক হয়ে যায়। বলে, চিনেন আমাকে?
খুব চিনি। আপনি তো রোড ডেরাইভার। দেখিছি কদিন শারিবার ঘরোৎ যাবা-আসবা।
হানিফ কেমন আবেগরুদ্ধ হয়ে যায়। শহুরে সপ্রতিভতা নষ্ট হয়ে যায় তার। শুধু অনেক চেষ্টায় বলতে পারে, খুব মেহেরবানি আপনার।
দু-জনেই দু-জনার দিকে খুব নির্জলা দৃষ্টিতে তাকায়। শেষে পলবি বলে, হামার নাম পলবি। ইয়াসিন বাজিকর হামার বাপ। যান, আপনার বেলা হোই যায়। নাহেন গিয়া।
পলবি চলে যায়। হানিফ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে দিকে। এই তাহলে পলবি। এর কথা সে শুনেছে কিছু কিছু।
সারাদিন রাস্তার রোলার চালানোর সময় পলবির কথা চিন্তা করে হানিফ। বাজিকরের বেটি, কেমন বা হবে কে জানে। তারপরে যা সব শুনেছে তার সম্পর্কে, সে তো একখানা পুরো কিসা। তবুও প্রথম দর্শন থেকেই তার যেন মনে হতে থাকে, একেই তো খুঁজছিলাম। প্রাণখো মানুষ সে। কোনো ব্যাপারেই দেরি সয়
সন্ধ্যাবেলা শারিবার ঘরে বসে তাড়ির গেলাস হাতে নিয়ে বলে, নিশা খাওয়ার আগেই একটা কথা বলি, নালে পরে বলবা যে নিশার খোয়রা বেচাল বলি।
শারিবা বলে, কি কথা?
তুমাদের ঐ কী য্যান বলে, ঐ পলবি নামের মেয়েটা—
হাঁ, কী করিছে সি আপনাক্?
শারিবা শঙ্কিত হয়।
মারে ফালাছে। একদম সাবাড়।
মানে?
আচ্ছা গাড়োল তো! আরি, উ মেয়াটার কথা আমি কেছু শুনবার চাছি।
শারিবা একটু দ্বন্দ্বে পড়ে। পলবির কথা এ অঞ্চলে সবাই জানে। কাজেই তাকে মানুষের প্রয়োজনের কথা মনে হয় একটা কারণেই। কিন্তু হানিফকে তো এ পর্যন্ত তার সেরকম বেচাল কেছু মনে হয়নি। সে একটু গম্ভীর হয়ে বলে, কি কবার চাছেন হানিফ ভাই, এটু পস্কার করি কহেন।
উয়ার কথা আন লোকের কাছে কেছু শুনিছি। কিন্তু এখন তুমার কাছ থিকা কেছু শুনবার চাছি।
ক্যান্?
আরি, আচ্ছা ঝামেলা তো! আরি, আমি এটা তাব্বিয়াত্ পুরুষমানুষ, এটা মেয়ার খোঁজ নিবার পারব না?
পলবিরে আপনে–!
ক্যান বিয়া করবার চাইতে পারি না?
না, তা লয়। তবি পলবি—
ক্যান, খুব খারাপ মেয়া?
না, মানে—
হানিফ এবার গেলাসে চুমুক দেয়। বলে, শোন শারিবা, আমি হানিফ মহম্মদ, অনেক ঘাটের পানি খায়া এখন সরকারি চাকরি করি। রোড রোলার চালাই। দুনিয়াটা আমার কেছু দেখা আছে। আমি এমন কিছু সাধু ফকির নই যি ব্যালপাতা আর কোরানশরিফ খায়া থাকি। তুমিই বলিছিলা যে, বাজিকরের জাতফাত নাই। আমারও এখন এটা সংসার করা দরকার। হা-ঘরে মোছলমানের ছেলা আমি। আমাদের মালদা জিলায়, মনে কর সব শালাই নাকি নবাব বাদশার ঘর। বিহাসাদির কথা ওঠলেই সব পক্ষ গৌর আর আদিনায় পুরান ইমারগুলা দেখায়। মনে কিনা, সব ঐসব বংশ। এছাড়া আর যা জোটে ভাতে আমার মন টানে না। তোমাদের পলবিরে চোখে লাগিছে। তবে সূর্য কর্থার আগে তোমার কাছ থিকা শুনতে চাই।
শারিবা একটু চিন্তায় পড়েহানিফের মতো সমর্থ পুরুষমানুষ বাজিকর মেয়ের কাছে রাজপুত্র। হানিফ কি সব শুনেছে? সব শুনেও সে কি পলবিকে গ্রহণ করতে পারবে? যদি পারে, শারিবার বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে যাবে। বাজিকর পুরুষ হিসাবে পলবির এই অবস্থার জন্য সে কি নিজেকেও অপরাধী মনে করে না? সে বলে, দেখেন হানিফ ভাই, পলবি বাজিকরের সোন্দরী মেয়া।
লুট হয় পাঁচ হাতে নাড়াচাড়া পড়িছে। ইসব তো আগে জানা লাগে।
ওসব আমি জানি, শারিবা। যিটা জিজ্ঞাসা করি সিটার জবাব দেও। আগে বল মানুষটা কেমন? ঘর করবা চায়?
চায়। খুব বেশি করিই চায়। আমি মোছলমান বলে তোমাদের আপত্তি হবে না?