ইয়াসিন চুপ করে। দুই বাজিকরের চোখে বংশপরম্পরায় শোনা ধূসর রক্ত, ঘাম আর অবিচারের ছবি এখন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কেননা এসব এখনো সত্য।
রূপা বলে, আমার পিত্তিপুরুষ জানত, বাজিকর হাল ধইল্পে মাটি ফালা হয়। বালি বেরোবে, জল দাঁড়ায় জল দাঁড়াবে না, বীজ ফেলে বিছন গজাবে না। হামার বাপ ইসব কথা বিশ্বাস যাতেন না। তাই তিনি হামরাদের থিতু করবা চালেন। ইয়াসিন বলে, থিতু হোবার বাস্লা হামার সাত পুরুষের মগজেৎ আছিল, কেন্তু সুবিধা হচ্ছিল না, তাই। এখুন দেখ, জামির বাজিকর মরি গেলেন, আর হামার মাথাৎ কি দায় চাপায়া গেলেন। সি দেশ নাই, সি দুনিয়া নাই, সি ভাষা নাই, সি নাচ গান ভুলি গিছি হামরা, নাটুয়া বাজিকর, ভাতির বাজিকর, ভাল্লুকুকুর-বান্দর লাচানো বাজিকর কোথায় হারাই গিছে, কেন্তু দুন্নাম পুরাই আছে। ঠগ জোচ্চোর বাজিকর, কামচোর বাজিকর, অজাত বাজিকর, জড়িবুটি হাতসাফাইএর বাজিকর, গুণতুক মানুষ ভুলানো বাজিকর, ই বেবাক বদনাম হামরার থাকি গিছে।
রূপা বলে, সর্দার, মালদা টাউনোৎ কাপড়পট্টিতে গুজরাটি দোকানদারের বুলি আর হামরার বুলিতে মিল আছে। ও
আছে। বালি বুঢ়ার কাছে শুনেছি, হামরা উসব দিকেরই মানুষ। এখুন আসল কথা শোন। হাজিসাহেব হামরার মুরুব্বি হইছেন। বাজিকরের ধরম নাই, জাত নাই। কালীমাই, বিগামাই, ধরভিমাইয়ের কথা মানষে ভুলে গেছে। এখুন হামার পরামর্শ হয়লো এটা কোট ধইরে লওয়া। হাজিসাহেব শক্ত মানুষ। মোছলমান সমাজে উঁচা-নিচার বাচ-বিচার নাই, ছোঁওয়া-ছানির বিচার নাই। একে আরেকের সাথ একসাথ ওঠবস করে, খানাপিনা করে, বিহা সাদি করে, সব থিকা বড় কথা হামরার জমি হবে। হাজিসাহেব ইসব বাত করিছেন হামার সাথ। হামার বিশ্বাস, তুমার বাপ বাঁচে থাকলে ইতে সায় দিতেন। তুমু না করেন না, উপা বাজিকর।
রূপা দীর্ঘ সময় চুপ করে থাকে। অনেক আগেই সে এসব চিন্তা করে রেখেছে। হিন্দু ঘরের মেয়েকে সে ঘরে এনেছে। শরমীর ভিতরে হিন্দু সংস্কার প্রবল। সেই সংস্কার রূপার ভিতরে শিকড় গেড়ে বসেছে। শরমীর হাতে শাঁখা তার চোখে নতুন অভিজ্ঞতার পবিত্রতা আনে। তার ঘরে আছে মা মনসার ঘট। তারা আবেগে বিষহরির পালা গায়। এখন আর তার পক্ষে মুসলমান হওয়া সম্ভব নয়। এবং শারিবাকেও সে পৃথক হতে দিতে পারে না। ধর্মের বিরোধ সে জানে। রূপা বলে, সদার রূপায় যখুন আর কেহ নাই, বাঁধা হামি দিমো না। তবি হামা জোরাজোরি করেন না। হামার ঘরণী হিদু। হামার ঘর বাদ দেন, শারিবা বাদ দেন।
ইয়াসিন আশ্বস্ত হয়। তবুও গভীর বিষাদ দু-জনকেই আচ্ছন্ন করে। সারা জীবনের জন্য পৃথক হওয়ার প্রস্তুতি নেয় তারা।
রূপা বলে, আরেক কথা মোনেৎ রাখেন। বাদিয়া মোছলমান, দাই, পাখমারা ইরা সব হামরার বাজিকরের মতন জাত। এখুন মোছলমান। কেন্তু মোছলমান সমাজ তারাদের নেয় না। একসাথ ওঠবস পর্যন্ত করে না, বিহাসাদি দূরের কথা।
ইয়াসিন বলে, ঠিক কথা। ওলা খোঁজখবর করিছি হামি। ইয়ারা শুন্যা মোছলমান। কোরানশরীফ ছুঁয়া, কাৰ্মা পড়া মোছলমান হয় নাই। মোছলমান সামাজের সাথ সাথ থাকতে থাকতে মোছলমান হয়াছে। জাতপাতের বিচার নাই, কিরাকাম করে না, নামাজ-রোজা, জুম্মা-জিয়াপৎ কেছুই মানে না। হামরা সিভাবে মোছলমান হচ্ছি না। ষোলই কার্তিক মহরমের দিনে আমরা কলমা পড়ব, মোছলমান হব। তা-বাদে একসাথ নামাজ পড়া হবে, একসাথ খানাপিনা হবে। হাজীসাহেব হামরাদের সাথ পাত পাড়বে, আর আর মোছলমান ইমানদার মানুষ হামরাদের সাথ পাত পাড়বে। হামরা উঁচা হব, হামরাদের জাত হবে।
রূপা বিড়বিড় করে বলে, হামরাদের জাত হবে! কি হবে তা মাও বিষহরিই জানে। হামি হিন্দু হলাম, তুমু মোছলমান হলেন। হিন্দু হামা জাতে লেয় না, মোছলমান তুমায় জাতে লিবে, সি বিশ্বাস হামরি নাই। বহুৎ দেশ দেখা আছে মোর। তবু রূপায় যখুন নাই, যান তুমরা, হর্ন মোছলমান। এখন তো বাঁচেন, দলকে বাঁচান। তা-বাদে মাও বিষহরিব মানৎ যা আছে, তাই হবে। কেবা জানে, হয়ত একদিন তুমার বেটা হাম মাথাৎ ডাং মারবে ‘শালে হিন্দু বলে, আর হামার বেটা তুমার বুকে ফাল্লা বিধবে ‘শালা মোছলমান’ বলে। জয়, মাও বিষহরি। সন্তানরে দেখেন, মাও।
রূপা কপালে হাত ঠেকায়। দেখাদেখি ইয়াসিনও। দুই প্রৌঢ় যেন শেষবারের মতো একত্রে হাঁটে। যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্ত দিয়ে দুই যাযাবর গোধূলিতে নিজেদের তাঁবুতে ফিরছে। আর কোনোদিন সেই তাঁবু থেকে সূর্যোদয় দেখতে বেরোবে না। দুজনের কেউ আর কথা বলে না। মাঠের ওপারে সূর্য ঢলে পড়ে। গভীর রক্তাক্ত যাযাবরী ‘তরক। দুইজনে সেইদিকে তাকায়। দু-জনে দু-জনের মুখের দিকে তাকায় তারপর। সত্যিই কি ঘরে ফিরতে পারবে বাজিকর? পথ তাকে অভিশাপ দেবে না? প্রান্তর তাকে ঝোড়ো হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে anTT?
দু-জনে একটা গাছের নিচে বিশ্রামের জন্য বসে সুর্যাস্ত দেখে। সূর্য ডুবে গেলে তারা যেন জামির বাজিকরের কণ্ঠস্বর শোনে, ‘বাপাসকল, জানবার হয়ো না। চেষ্টা লাখ, যাতে বিটিয়া দূরে যায় আর বেটারা দূর থিকা আনে। শোগর, মরি আর ওয়া—জন্ম, মৃত্যু আর বিহা—এই তিনকে হিসাবের মধ্যে রাখ, নিয়মের মধ্যে রাখ।
৫৫.
আয়নার খাঁড়িতে স্নান করতে গিয়ে হানিফ জলপরি দেখে। সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ে। চারদিকে জঙ্গল, কয়েকটা তালগাছ এবং দুটো খুব উঁচু মাদার গাছ। জঙ্গল বলতে ভাট আর আসশ্যাওড়ার ঝোপ! তার মধ্যে দিয়ে আয়নার খাঁড়ি বয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে স্নান করার মতো গভীরতা আছে। হয় মানুষ নিজের প্রয়োজনে করে নিয়েছে, নয়তো বাঁকের জন্য হয়েছে। এই সময় জল থাকে ভালোই, মানুষের প্রয়োজনে লাগে। ভারি নির্জন জায়গা।