এক এক সময় ইয়াসিনের মনে হয় চতু আর আনোয়ার বাজিকরই ঠিক বলত। বলত বানজারা বাজিকরের সারা দুনিয়াটাই ছিল, সে ছিল সারা দুনিয়ার রাজা। কি যায় আসে তার ছেড়া তাঁবু, শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়, রুগ্ন পশুর দল? তার ছিল ভরপুর জীবন, বিশাল বিস্তৃতি। চতু আর আনোয়ার তাদের পূর্বজীবন ভুলতে পারেনি। পাঁচবিবিতে থাকতে হরদম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ত তারা। তিনবার লালামিয়ার ঘোড়া চুরি করে উধাও হয়ে গিয়েছিল তারা। ধলদিঘি কিংবা খাগড়ার মেলায় নিয়ে বেচে দিয়ে দীর্ঘদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু দল না থাকলে যাযাবরের কিছু নেই। প্রতিবারই ফিরে আসতে হতো তাদের। প্রতিবার জামির তাদের শাসন করত, রক্তাক্ত করত মেরে।
এখন ইয়াসিন থানায় যাচ্ছে। থানা-পুলিশ থেকে বাজিকর চিরকাল দুরে থাকে। পুলিশ তার শত্রু। পুলিশকে সে ঘাটায় না। ইয়াসিন প্রথম বাজিকর যে নিজের প্রয়োজনে পুলিশের কাছে যাচ্ছে।
সোনামিয়া ঠিকমতো শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়। সঙ্গে একজন মুহুরি দেয় ডায়েরির বয়ান ঠিকঠাক যাতে এরা বলতে পারে সেজন্য।
থানা অফিসার বলে, বাদিয়া মুসলমান, বাজিকর আর পাখমারা নলুয়া এই তিনজাত বহুত হারামি। তবে থানায় এসেছ, এটা ভালো লক্ষণ।
মুহুরি বলে, না স্যার এরা গেরস্থ লোক। চাষবাস আর পাইট খাটে খায়। ঝামেলা তো কদাপি করে না। কেন্তু এদানি বড় ঝামেলায় পড়ি গেছে, আপনি যদি না দেখেন—
কেন? আমি দেখব কেন? আমি কোন্ শালা?
ইয়াসিন আর রূপা হাতজোড় করে থাকে শেখানো কথা কিছুই মুখে আসে। মুহুরি বোঝে, বড়বাবু কিছু স্তুতি শুনতে চায়।
সে বলে, হুজুর, আপনি হলেন দণ্ডমুণ্ডের কত্তা। রাখলেও আপনি, মরলেও আপনি। বাদা-কিসমতের হাজিসাহেব আপনার কথা কয়ে আমাক পাঠালো আপনার কাছে। হাজিসাহেবের বাপের সিই হাতির বেপারটা এখুনো তিনি মোনেৎ রাখেন। ফির হজে যাওয়ার আগে পাঁচফোটের বেপারে আপনার কেরামতিও স্মরণে আছে তার! ওঃ ভালো কথা, একেদিন দাওয়াতের অনুমতি চায়ে পাঠাছেন। যদি অনুমতি করেন, হাজিসাহেব নিজে এসবে আপনাকে দাওয়াত জানাতে।
মুহুরি পাকা লোক। বড়বাবুও কঁচা নয়। কিন্তু তোষামোদের মজা এই পাথরও গলে, আর এ তো বড়বাবু!
হাজিসাহেবের বাপের আমলে হাতি ছিল। সে আমলে অবস্থাপন্নদের হাতি রাখাটা একটা বিশেষ বড়লোকি ও সম্মানের ব্যাপার ছিল। হাতিটা ছিল বুড়ো। মরার আগে হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে দু-দু-জন মানুষকে খুন করে। হাজিসাহেব বড় বিপদে পড়েছিল। এই বড়বাবু তখন এখানকার মেজবাবু ছিল। হাজিসাহেবের হেপাটা তখন সেই সামলায়।
স্তুতিতে বড়বাবু কানে আরাম পায়। বলে, হাজিসাহেবকে আমার সেলাম জানাবে। যাব একদিন আমি নিজেই। তা এদের জন্য আমি কী করতে পারি?
মুহুরির আর বিশেষ বেগ পেতে হয় না। বিষয়টা পরিষ্কার করে বোঝায়। দারোগা বলে, ঠিক আছে, আমার জানা রইল। জেনারেল ডাইরি একটা দিয়ে যাও। কিছু ঝামেলা হলে আগেভাগে খবর দিও।
কাজ শেষ হলে ইয়াসিন আর রূপা নিচু হয়ে সেলাম করে। মুহুরি বলে, বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, আমি আসি।
ইয়াসিন খুব কৃতজ্ঞ বোধ করে। হাজিসাহেব আর সোনামিয়ার মতো মুরুব্বি হলে এ যাত্রা বাঁচা যেত না। ইতিমধ্যে ধর্মান্তর গ্রহণের ব্যাপারটা সে পাকা করেছিল হাজিসাহেবের সঙ্গে। রূপা এখনো সেকথা জানে না। ব্যাপারটা গোপনেই আছে। হাজিসাহেব তাকে জানিয়েছে, অঞ্চলের তাবৎ অবস্থাপন্ন মুসলমান এ উৎসবে বাজিকরদের সঙ্গে থাকবে। মোলই কার্তিক মহরমের দিন বাদা-কিসমতের মসজিদে বাজিকররা সদলে মুসলমান হবে। বাজিকররা জাত পাবে, পাত পাবে, পোশাক পাবে, আর যাতে থিতু হতে পারে তার জন্য মুসলমান জোতদাররা তাদের নিজ নিজ জমি থেকে বাজিকরদের আধি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
ইয়াসিন মজলিশ না ডেকে প্রতি ঘরে গিয়ে গোপনে শলাপরামর্শ করছে। সামনে দিশেহারা অন্ধকার। কোথায় যাবে মানুষ? রাজশাহি, আমুনাড়া, পাঁচবিবির তাড়া খাওয়া বাজিকর এবার যে-কোনো মূল্যে স্থিতি চায়। আপত্তি বিশেষ কেউ করেনি। দু-চার ঘর যারা নিজ পরিচয় গোপন রেখে বাইরে থেকে হিন্দু মেয়ে ধরে এনেছে, তারাই কেবল আপত্তি করছে। কিন্তু ইয়াসিনের বড় ভয় রূপাকে। রগচটা রূপা কিভাবে এই সিদ্ধান্ত নেবে ভাবতে সে ভিতরে ভিতরে দুর্বল হয়ে যায়। তবুও ঘরে ফেরার পথে রূপাকে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা, এরকমই তার
পরিকল্পনা।
সোনামেলা ছাড়িয়ে এসে ইয়াসিন বলে, উপা বাজিকর, এটা কঠিন গপপো WICI
তার বাচনভঙ্গিতে রূপা থমকে থেমে যায়। ইয়াসিন নরম মনের মানুষ, সে এত গম্ভীর কথা বলে কেন?
উপা বাজিকর, তুমু জামির বাজিকরের ছেলা। বাজিকরের বিপদটা তুমার বুঝা লাগে।
বুঝলাম। সি-ই তাল। মোছলমান হোবার তাল।
হাঁ, মোছলমান হোবার তাল! বাজিকরের বেটা তুমু, সব থিকা বড় কথা, জামির বাজিকরের বেটা। জামির বাজিকর গোরৎ যাওয়ার আগে হামা মণ্ডল করি দিয়া যায়। আর লিয়মমতো বাজিকরের তাবৎ বোত্তান্ত হামাকেই বলে। সে কথা তুমার আইজ শুনা লাগে।
বল, শুনি।
গোরখপুরের কথা কেছু জানেন তুমু। কেন্তু তার আলা কথা জানেন না।
না, জানি না।
সি আলা দেশে হামরা আছিলাম এদেশের ডোম আর চাঁড়ালদের সমান অছুৎ জাত। জাতের মানুষ হামারদের হেঁয়া মাড়াত না। দিনেমানে আস্তাৎ যাওয়া নিষেধ ছিল। গেলে কেনেস্তারা বাজাবার হোত। পাছায় বাঁধতে হোত বারুন। হামারার কাজ ছিল। ভিখ মাঙ্গা, ঘোড়া, গরু আর ভঁইসের পায়েৎ নাল লাগানো, জানোয়ার খাসি-বলদ করানো, শ্মশানে, কব্বরখানায় অদ্ভুৎ কাম। খালি আজায় আজায় যুদ্ধ হলে হামরাদের কেছু কাম বাড়ত, কেছু কাম পাতাম আমরা। লড়াইতে হাজার কাম থাকে। শতেক ময়লা কাম, অছুৎ কাম। সিগলা হামরা করতাম। আর হামরা গান গাইতাম, লাচতাম, হামরাদের বিটিগুলা ভালো নাচনি আছিল। আর সি সব দিনে খালি লড়াই আর লড়াই। সি লড়াইয়ে আমরা মরতাম দলে দলে। লড়াই শেষে শিকলবন্দি গোলাম হয়া চালান যাতাম দূর দূর দেশেৎ। ই ভাবে আমরা জাতের হুজ্জতি আর লড়াইয়ের দাপটে ছাড়েখাড় হোই গিলাম। মান নাই, ইজ্জৎ নাই, জমি নাই, ঘর নাই। নাচ আছে, জানা আছ হরেক হাতের কাম। ই সব কথা হামাক, বালি বুঢ়াও কহিছিল।