হানিফ হাসে। বলে, চা খিলাবেন আমা? হা-হা-। চলেন, চলেন।
এর মধ্যে হাসির কী আছে শারিবা ববাঝে না। হানিফের উচ্চারণে কিছুটা শহরে বুলির মিশ্রণ আছে। তার চেহারাটা বড়সড়, পরনে খাকি রঙের প্যান্ট শার্ট।
মোহরের চায়ের দোকানে চা খেয়ে যখন তারা বের হল তখন সন্ধ্যা হয়ে গছে। হানিফ বলে, চা খায়ে জুৎ হোল না। চোয়ানি পাওয়া গেল না তোমাদের ( দেশ?
শারিবা বলে, হাটের দিন ছাড়া চোয়ানি পাওয়া কঠিন।
হানিফ একটু হতাশ হয়। বলে, সারাদিন রোদে পোড়া কাম। নেশা না হলে রক্ত সব জল হোই যাবে। তাড়ি পাওয়া যাবে না?
তাড়িও ভাল পাবেন না এ সময়। তালের তাড়ির সময়তো ইটা লয়। খেজুরের তাড়ি পিইবেন তো বলেন, বেবস্থা করি।
খেজুরের তাড়ি? খাই নাই কখনো। কেমন হয়?
তালের মতো অত ভালো স্বোয়াদ হয় না, এটু তিত্কুটি হয়।
নেশা হয় তো?
হুঁ, নিশা হয়।
চলো তবে।
তাড়ির জন্য শারিবাকে চেষ্টা করতে হয় না। আকালু আজকাল আর হাপু গায় না। সে এখন পাশীর কাজ করে। তার হালকা ক্ষিপ্র শরীরে কাজটা সে ভালোই পারে। এ দেশে নেশা প্রায় প্রত্যেকটি মানুষই করে। কাজেই তালের তাড়ি যখন নামতে থাকে তখন তার রোজগার খারাপ হয় না। এ ছাড়াওসে মাঝে মধ্যে খড়ের ব্যবসা করার চেষ্টা করে। কারো গরুর গাড়ি ভাড়া করে খড় কিনে নিয়ে সারারাত গাড়ি চালিয়ে শহরে যায়। শহরে খড়ের ভালো দাম পাওয়া যায়।
শারিবা হানিফকে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। মানুষটা বেশ প্রাণখোলা, বেশ ভালো লাগে তার। আকালু তাড়ি আনে। মুড়ি পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা সংগ্রহ করে আনে। হানিফ নেশা করে। শাবিবা অতিথির সম্মান রাখতে আধা গেলাস নিয়ে চুমুক দেয়।
হানিফ বলে, ও কি খাওয়া? চ্যাংড়ার মতন ঠোঁট ছোঁয়াছ!
হামার নিশা খাওয়া অভ্যাস নাই, হানিফ সাহেব।
কেন?
নিশা খালে মাথাটা জুতে থাকে না, পরে খুব বে-আক্কেল লাগে নিজেকে।
আরে, সি জন্যই তো মানুষ নিশা খায়! আজব মানুষ!
শারিবা হাসে। বলে, আপনে খান সাহেব।
হানিফ তাকে ধমকে ওঠে। বলে, ধেত্, সাহেব সাহেব করছ কেন বল তো? বয়সে তুমার থিকা পাঁচ-সাত বছর বড়ই হব। ভাই বলে ডাক। তুমার নামটা জানা হয় নাই।
আমার নাম শারিবা।
শারিবা কি?
শারিবা বাজিকর।
কোন জাত?
শারিবা চুপ করে থাকে। সেই প্রাচীন প্রশ্ন হানিফও করে।
হিন্দু, না মোছলমান?
হামরা বাজিকর, হানিফ ভাই।
বাজিকর কোনো জাত নয়।
তবে হামারদের জাত নাই।
জাত নাই এমন মানুষ নাই। হয় হিন্দু, নয় মোছলমান, নয় খৃস্টান—
ইয়ার এটাও মোরা লই।
আধশোয়া অবস্থা থেকে হানিফ উঠে বসে। তার মাথায় তখন নেশা ধরে এসেছে। সে বলে, তাজ্জব! এমন কদাপি শুনি নাই। গরু খাও?
খাই।
হারাম-শুয়ার?
খাই।
তাজ্জব! তুমি আমার নিশা কাটাই দিলা হে!
সে আবার তাড়ি নেয়। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ নেশা করে। শেষে আবার বলে, তাজ্জব! এমন মানুষও এ দেশে আছে যার কোনো জাত নাই।
অন্ধকারে পাতালুর বাঁওড়ের দিক থেকে উত্তরের প্রথম হাওয়া এসে গ্রামে ঢোকে। গাছের পাতা কাঁপায়। খড়ের চালুর পুরানো খড় বর্ষায় পচে, এখন শুকনো হওয়া পাতার গুঁড়ো উড়ে নিচে পড়ে। অন্ধকার ঘন হয়। ওমরের মা বিনিয়ে বিনিয়ে গান গায়, এ সে হাদি লাগিরে এতো মায়েরি-পলবি কোনো দুঃসাহসী প্রেমিককে নোংরা গালাগাল দেয়। কাছেই একটা কুকুর ডেকে উঠেই থেমে যায়। ওপাশের ঘরের কাছ থেকে প্রথমে পুরুষ ও পরে নারীকণ্ঠের ‘জয় মা মনসাশুনে শারিবা বোঝে রূপা-শরমী ফিরে এল। আকালু হাঁড়ির গায়ে নেকড়া লাগিয়ে তারি ঢালে। এতক্ষণ যে অনর্গল কথা বলছিল, সেই হানিফ এখন কোন অজ্ঞাত কারণে যেন থম্ ধরে থাকে ও মাঝে মাঝে গেলাসে চুমুক দেয়।
শেষ গেলাসের নিচে ঘন তলানিটুকু হানিফ বাইরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গেলাসটা সামনেই উপুড় করে রাখে, অর্থাৎ আর নয়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, জাত থাকলে বেজাতও আছে। যার জাত নাই, বেজাতও নাই। তুমরাই ভালো আছেন গো। তুমাদের জাতও নাই, বেজাতও নাই। এই মনে করেন, হামি হলমা মুসলমান জাত, হামার চোখে হিন্দু হলেন বেজাত। আমি বলব, মার শালা হিঁদুকে। ফির হিঁদুর চোখে আমি হলাম বেজাত। মার শালা বেজাত মোছলাকে। তাই, মনে করেন তুমরা, হামার মা আর ভাই খুন হয় আর বুন নোপাট হয়া যায়। আর হামি তকন রোলার গড়ায়ে রাস্তা বানাই। আর সি রাস্তায় বেবাক জাত হাঁটে যায়। তুমরাই ভালো আছেন, তুমাদের জাত নাই, তুমাদের বেজাতও নাই।
লক্ষের আলোয় হানিফের নেশায় ভারি চোখ চিকচিক করে। তার গলার স্বর জড়ানো এবং দুরবর্তী। শারিবা তার কথার কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। কিন্তু কোথাও কোনো ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে, তা বোঝে। ব্যাপারটা এত আকস্মিক যে সে কিছু বলতে পারে না।
খেজুরপাতার মাদুরের উপরে হানিফ গড়িয়ে পড়ে পুরোপুরি। হাত-পা আলগা হয়ে যায় তার। আকালু তার পা দুটো টেনে সোজা করে দেয়। হানিফ কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে।
৫৪.
পরদিন রূপাকে সঙ্গে করে ইয়াসিন যখন থানায় যায় তখন দশজন বাজিকর পায়ে মোটা করে বস্তা বেঁধে পাথরকুচির উপর গলানো পিচ ঢালে। তার মধ্যে শারিবা একজন। বাজিকরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন থানায় নালিশ করতে যায় অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য। ওমর যখন খুন হয়, আজুবা তখন ভায়রোর বিরুদ্ধে থানায় ডায়েরি করতে বলেছিল ইয়াসিনকে। ইয়াসিন রাজি হয়নি। আজুরার সঙ্গে ভায়রোর নিজস্ব কিছু বিরোধ আছে। তাছাড়া খুনের কোনো প্রমাণ ছিল না। শারিবা চাঁদের আলোয় সবই দেখেছে বটে, কিন্তু কাকে দেখেছে, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না।