ইয়াসিন বলে, সিগ্লা তো পরের চিন্তা, হাজিসাহেব। ইদিকে যে দশ দিনের কড়ার পার হয়। মাগ, ছোল পোল, বুঢ়া বুড়ি নি যামো কুন্ঠি?
তাদের কথার মাঝখানে আরেক ব্যক্তি এসে বসেছিল। সে ব্যক্তি সোনা মিয়া নামে এ অঞ্চলে পরিচিত। বাজিকরদের সাথে তার যোগাযোগের কোনো কারণ নেই। কেননা, সোনামিয়া এ অঞ্চলের তশিলদার। যারা পরের জমিতে বাস করে তশিলদারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকে না। এতক্ষণ শুনে সে উৎসাহিত হয়। হাজিসাহেবের পাকা মাথার তারিফ করে মনে মনে। প্রকাশ্যে বলে, কেন্তু বেপারটা কি? তুমাদের উচ্ছেদ করে কেয়?
আজুরা মণ্ডল।
কেংকা।
তার জমিতে যি বসত করি, সাহেব?
তার জমি? বলিছে বুঝি?
তার লয়?
তারও বটে, আবার তার লয়ও বটে।
হেয়লি রাখেক, সোনামিয়া। এটু পস্কের করে কন। এবার হাজিসাহেবও উত্তেজিত হয়।
আরি, তবি আর কই কি। উ জমি বেবাক ভেস্ট। বেবাক সরকারি জমি হোই গিছে।
তোব তোবা। এমন খবরটা অ্যাৎক্ষণ চাপি রাখে দম ফাটাচ্ছেন। তবিই দেখো শারিবা, আল্লা কত মেহেরবান!
ইয়াসিন বিষয়টা পরিষ্কার বুঝতে পারে না। সে আবেগে কাঁপতে থাকে।
পস্কের করি কহেন, মিয়া সাহেব। ঠিক বুঝ পারি না। সরকার ভেস্ট মানে কি?
সরকার ভেস্ট মানে সরকার ভেস্ট। উ জমিতে আজুরা মণ্ডলের আর মালিকানা নাই। উ জমি এখন সরকারের।
তবি তো সরকারে হামারদের উচ্ছেদ করবে!
পাগল! হামি আছি না?
তারপর বুদ্ধি পরামর্শ হয় হাজিসাহেব ও সোনামিয়ার মধ্যে। যত শিগগির পারা যায় দাগ খতিয়ান দেখে প্রতি বাজিকর পরিবারের নামে একটা করে খাজনার রসিদ কেটে দেবে সোনা মিয়া। হাজি বলে, দেখো মিয়া, নেংটা গরিব সব। গলা কাটবা পারবা না তুমরা। ঘর প্রতি দশ টাকা দিবে। তাও কম হবে না, একশত বাইশ ঘর আছে। ওই দিয়া সাহেব আর আপিস তুষ্ট করবা। ফির, ই কথাটাও মোনৎ রাখেক, ইয়ারা বেবাক আল্লার বান্দা হবার যাছেন।
সোনামিয়া বলে, ঠিক আছে, কথা দিলাম। সাত দিনের মধ্যে বেবাক কাম শেষ করমো। আর ইয়াসিন মণ্ডল, তুমরা আরেক কাম করেন। কালই থানায় যান, অ্যাটা ডাইরি করেন যি, ভেস্ট জমি থিকা আজুরা মণ্ডল তুমাদের বলপূর্বক তছেদ করবা চাছে, ভয় দেখাছে, তারসাছে, ইসব।
থানাৎ যামো!
ইয়াসিনের মনে পড়ে অনেক কাল আগের রাজশাহির থানা, জামিরের বিচার ও জেল, সেই ভীতি।
ক্যান্, ভয় কিসের?
ভয় লয়।
আরি, সদরোৎ তো আসেন, হামি আছি না?
শারিবা ধীরে ধীরে বিষয়গুলো বুঝবার চেষ্টা করে। জমি-জমার বৃত্তান্ত খুবই জটিল, এই ব্যক্তি সেই জটিল জগতের একজন। ইয়াসিন কিছুই বোঝে না, তাই সব কিছু জেনে বুঝে নিতে চায় একবারেই।
সে বলে, কিন্তু খাজনার আসিদে হামরার কী হবে, সাহেব? আরি, খাজনার অসিদ হইল চেক। চেক-ফড় ইসব বুঝা আছে?
না, সাহেব।
চেক কাটলা এর মানে হইল, তুমার নামে সরকারি জমা হইল, তাথে তুমার দাবি হইল।
জমি সরকারের, তবি হামার দাবি কেংকা হয়?
আরি আহাম্মক, সরকার ওই জমির পত্তনি দিবে তো, এখুন তুমার নামে চেকফড় থাকলে, আর তুমার দখল বলবৎ থাকলে পাট্টার দাবি তুমার আগে। তখুন তোমা উচ্ছেদ করে কোন্
অনেক নতুন শব্দ শোনে তারা, বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে অনেক নতুন বিষয়ের। দখল, উচ্ছেদ, বলবৎ, চেক-ফড়, পাট্টা, এইসব শব্দ এই দুই বাজিকরই প্রথম শোনে। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো বাজিকরের সৌভাগ্য হয়নি এসব শোনার বা এইসব জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করার।
হাজি সাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসেই তারা রাস্তা তৈরি করার রোলারের শব্দ শোনে, একটানা ঘরঘর শব্দ। ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা এখন পি. ডবলিউ. ডি-র রাস্তা হয়ে গেছে। যে রাস্তার পাশে বাজিকরদের বসতি, সেই রাস্তা পাকা হচ্ছে। সদর শহর থেকে রাস্তা বেরিয়ে সোজা এগিয়ে আসছে। এখন বাজিকরপাড়ার কোনো উঁচু জায়গায় দাঁড়ালে মাইলখানেক দূরেই কালো ফিতের মতো পিচের রাস্তা দেখা যায়। এই রাস্তায় নাকি মোটর-বাসও চলবে।
৫৩.
ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা পি. ডবলিউ. ডি-র হাতে এসে পাকা হয়। সদর শহর থেকে বেরিয়ে এসে বাদা-কিসমতের মাঝখান দিয়ে, মোহরের পাশ দিয়ে, ব্লক অফিসের দিকে রাস্তা এগোয়। সেখানে থানাও আছে। সেখান থেকে রাস্তা আরো পারো-চোদ্দ মাইল এগিয়ে বড় হাই রোডে গিয়ে পড়বে।
মোহর হাটখোলার মোড়ে চার-পাঁচখানা স্থায়ী দোকান গজিয়ে ওঠে। সকালে একবার এবং বিকালে একবার চায়ের দোকানের উনুনে আগুন জ্বলে। সবাই আশায় থাকে কবে বাস-যাতায়াত শুরু হবে। এখন শুধু মোহরের হাটের দিনে সদর শহর থেকে একখানা হাট-বাস সপ্তাহে দু-দিন যাতায়াত করে।
রাস্তা তৈরির কাজে প্রচুর মজুর খাটে। অধিকাংশই সাঁওতাল ও ওরাওঁ। ঠিকাদারের লোকের সঙ্গে একদিন কথা বলে আসে শারিবা। বাজিকরপাড়ার কয়েকজন রাস্তা তৈরির কাজে নিযুক্ত হয়। অবশ্য ব্যাপারটা এত সহজে হয় না। সাঁওতাল, ওরাওঁ মজুরকে সবাই চেনে। তাদের দিয়ে কতটা কাজ ও কিভাবে কাজ পাওয়া যায়, ঠিকাদার জানে। কিন্তু বাজিকর? এ জাতের নামই শোনেনি সে কোনোদিন। প্রথমে শারিবাকে রাসুন্ধি না-ই করে দেয়। পরে রোড-রোলারের ড্রাইভার হানিফের কথাতে ঠিকাদারের ম্যানেজার পরীক্ষামূলকভাবে দশজনকে কাজে নিতে রাজি হয়। তবে বাজিকর মজুররা আপাতত রেজার রেটে কাজ পাবে, এমনই শর্ত হয়।
শারিবা রাজি হয়ে যায়। নতুন শেখা পাটোয়ারি বুদ্ধিতে হানিফকে কৃতজ্ঞতা জানায়। বলে, আপনার জন্যই কামটা হোল। চলেন, এটু চা খাই।