চতুর্থ দিনেও একই অবস্থা দেখে নেশার ঘোরে পলবির মাজায় একটা লাথি মারে আজুয়া।
পলবি নিমেষে জ্বলে ওঠে ও ত্বরিতে উপরের মাচায় আটকানো হেঁসোখানা টেনে নামায়। মুখে কিছু না বলে ভীষণ দৃষ্টিতে আজুয়ার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে সে। আজুরার ভীষণ মুখ ভীষণতর হয়। সে নড়তে পর্যন্ত সাহস পায় না। মুহূর্তগুলোকে মনে হয় অনন্ত। পলবির চোখের পাতা পড়ে না। তার যাযাবরী রক্তের আগুন ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে ওঠে চোখের তারায়।
খানিকক্ষণ পরে হেঁসো ঘুরিয়ে দূরজার দিকে ইঙ্গিত করে পলবি। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, বারাই যান, মণ্ডল। মায়ামানুষ জানোয়ার লয়। আর কুনোদিন বাজিকরপাড়ায় সেঁধাবেন না।
এসব ঘটনা কোনোকালেই দীর্ঘস্থায়ী সুফল আনে না। বরং বিপদ আরো বাড়িয়ে তোলে। দিনসাতেক পরে ইয়াসিনকে ডেকে পাঠায় আজুরা। প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে তারপর ঘর থেকে বের হয় সে। ইয়াসিন দেখে আজুরার ভয়ঙ্কর আকৃতির মুখ।
আজুরা বলে, রোডের পাশের জমিগুলান হামি বেইচে দিমো হয়, তুমাদের বসত ইবার তুলবা লাগে।
ইয়াসিন এতটা আশা করেনি। সে ভেবেছিল, আজুরা কিছুটা হম্বিতম্বি করবে, ইয়াসিন ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু সেসবের কোনো সুযোেগই থাকে না।
এত্তোগুলা জীবন নিয়া কুন্ঠি যামা, মালিক?
সিটা হামার দেখার কথা নয়। দশ দিনের সময় দিলাম। জমির খরিদ্দার ঠিক হইছে, বায়নানামা হইছে, কেন্তু তুমরা উচ্ছেদ না হলে জমি বেচা যাবে না। কাজিই তুমারদের উচ্ছেদ হবার লাগে।
আবার সেই দিন ক্ষণ তারিখের নির্দেশ, বাজিকরের জীবনে যা বড়ই অমোঘ। কাজেই আজুরার পা ধরতে যায় সে।
মালিক, এভোগুলা যেবন, বালবাচ্চা বুঢ়াবুঢ়ি। ক্ষমা দেন, মালিক। কুন্ঠি যামো মালিক?
পা ধরতে দেয় না আজুরা। সারে সরে যায়। বলে, এসব কথা হামা বলে লাভ নাই। টাকার দরকার, জমি হামার বেচবার হবে।
ইয়াসিনের চোখ থেকে জল গড়ায়।
হাজার বছরের অবহেলিত যাযাবর। সেই প্রাচীন পাপের কথা স্মরণ করে হামাগুড়ি দিয়ে আজুরার পা ধরার চেষ্টা করে। ক্ষমা কইরে দেন মালিক। হারামজাদীরে আমি চুলের গোছা ধইরে আপনার পায়ে আনে ফেলাব। কেবল একটিবার কহেন যি মসকরা করেছেন হামার সাথ।
আজুরা তার খর্বাকৃতি পায়ের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ইয়াসিনকে। বলে, অ্যাতক্ষণ বেবাক মজা আর মসকরা মোনং হইল তুমার? ভাল। কেন্তু সময় ওই দশ দিন। তার মধ্যে যা করার প্রবা।
আজুরা ভিতরে ঢুকে যায়। ইয়াসিন অনেকক্ষণ বসে থাকে সেখানে। চিৎকার করে বলবার ইচ্ছা হয়, জামির বাজিকর, থিতু হবা না, গেরস্থ হবা না। কি দায় চাপায়া গেলা মোর ঘাড়েৎ? মোরাদের পাপের কি শ্যাষ নাই!
৫২.
ওমর খুন হবার পর ওমরের মা পাগল হয়ে যায়। তিন দিন সে ঘরে চুপচাপ বসে ছিল। চতুর্থ দিন বিচিত্র বেশে সে রাস্তায় বের হয়। ঘাগড়ার মতো কুঁচি দিয়ে শাড়ি জড়ানো তার কোমরে। একটা কাপড়ের বোঁচকা তার পিঠে ঝোলানো। হাতে একখানা ঝাটা। দু-পা এগিয়ে আবার সে পিছন ফিরে আঁটা দিয়ে পায়ের দাগ মোছে। ঘন ঘন মাথার উপরে তাকায়, চোখের উপর হাত রেখে। মাঝে মধ্যে হাত ঘুরিয়ে গোল হয়ে নাচে, গান গায় অবোধ্য ভাষায়।
ওমরের মাকে এ অবস্থায় দেখে শারিবা থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুড়ি তার কাছে দ্রুত আসে। ফিসফিস করে বলে, শারিবা আটা কথা বলি তোক শোন। ‘তরক’ যখন মাথার উপরে থাকে তখন মানষের হেঁয়া মাটি পড়ে না, তখনই রাস্তাৎ বেবি। তার আগে না। আর সাঁঝ হলে, তখন তো বেবাক আন্ধার হোই যায়, তখন বেরাবি, বুঝলু?
ক্যান্ চাচি, ক্যান্?
আঃ, আহাম্মকটা! না-লে জেতের মানষের গাঁয়েৎ হেঁয়া পইড়বে না হামাদের? সিটা বড় অমঙ্গল রে, বেটা।
শারিবার নানির কথা মনে পড়ে। নানি বলত, হামরা তো অজুতের জাত রে, শারিবা। গোরখপুরে হামরা অদ্ভুৎ ছিলাম। তার আগেৎ যেথায় ছিলাম, সেথা তো হামারদের ছেয়া মাড়ানো পাপ! সেথায় অছুৎ জাতকে রাস্তাৎ যাতে হলে ক্যানেস্তারা বাজায়ে যাতে হয়। লয়তো, জেতের মানষের গায়েৎ হাওয়া লাগে, হেঁয়া লাগে। সি বড় পাপ!
পাপ! কার পাপ, নানি?
অছুৎদের পাপ।
ক্যান্?
পাপ লয়? তারা জি অছুৎ!
অদ্ভুৎ ক্যান?
সি-ই যি পাপ! পিত্তিপুরুষের পাপ। তাতেই তারা অচ্ছুৎ।
পিত্তিপুরুষের কী পাপ নানি?
জানি না, শারিবা। তুই এখন ঘুম যা।
শারিবা তাকিয়ে দেখে ওমরের মা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে, গান গাইছে, হাতে তালি দিয়ে তাল দিচ্ছে—
দেও আওয়ে তো দেওরে ভাই
বান্ধনা তো সারিমাদে
দেও আওয়ে তো দেওরে ভাই
মাকারানা সারিমাদে
দেও আওয়ে তো দেওরে ভাই
সাপনারা সারিমাদে।
শারিবার আবার নানির কথা মনে পড়ে। দুই হাতের আঁজলায় যৌতুক দেওয়ার ভঙ্গি করত নানি। এই তোর ‘ইওয়া’ হইছে রে, শারিবা। ইবার তোর ‘নওরিঁ’ হালদি মাখামু–।
শারিবা আর সহ্য করতে পারে না। দ্রুত সেখান থেকে সরে যায়। ইয়াসিনকে নিয়ে হাজির কাছে যেতে হবে। পরামর্শ করে এর থেকে বেশি কিছু আর মাথায় আসেনি কারো। তবু ঐ একটা মানুষ তাদের কিছু অন্য কথা বলেছিল।
আজুরা মণ্ডলের দশ দিনের তিন দিন পার হয়ে গেছে। সমস্ত লোক তাকিয়ে আছে ইয়াসিনের দিকে, শারিবার দিকে রূপা-শরমী সাপের ঝাঁপি নিয়ে বেরিয়েছে মাসখানেক হল। শীত নামার আগেই তাদের ফিরে আসার কথা। হয়ত, দু-এক দিনের মধ্যেই তারা ফিরে আসবে।
হাজি বলে, বসো ইয়াসিন মণ্ডল। বসেক শারিবা। ইসব কথা তো হামি জানতামই। আজুরা মণ্ডলরে তো আইজ লতুন চিনি না। কথা আরো একবার চিন্তা করেন তুমরা। মোছলমানের সাথই তুমাদের মিল বেশি। নাম হয় ইয়াসিন, জামির, ওমর। খাদ্যাখাদ্যে হিদুর সাথ মেলে না। গরুর গোস্ত খাও। হ, হারামও খাও বটে, তবি সিটা শুদ্ধ করি লওয়া যাবে। আবার দেখ, মরার পরে আমার যা তুমারও তা। সিই সাড়ে তিনহাত মাটি। নাই বা থাক কাফনের কাপড়, নাইবা রইল মোল্লা নাইবা করলা কব্বরের নিচে বাঁশের মাচান, তবু গোর তো বটে, আগুনের সাথতো সম্পর্ক নাই। ইবার বুঝ করে অ্যাটা কোট ধইরে লেও। বাঁচাবার বুদ্ধি অ্যাটা বার হোবেই।