ওমর আর মালতী ভাঙা নৌকা ছেড়ে প্রাচীন এবং পরিত্যক্ত এক মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল। ওমরের মা ও শারিবা তাদের খাদ্য জোগান দিত। অনেক চিন্তা করেও ওমরের জন্য কোনো সমাধান পায়নি শারিবা। এইভাবে লুকিয়ে কতদিন বাঁচা যাবে, একথা সবাই চিন্তা করত। কিন্তু অন্য কোনো উপায় কারো জানা ছিল না।
তারপর এক জ্যোৎস্না রাতে ওমর যখন তার প্রেমিকাকে নিয়ে নদীর বালি আর জলে চাঁদের আলো দেখে, আকাশে দুরযাত্রী হাজার হাজার হাঁসের পক্ষধ্বনি শোনে এবং শারিবার জন্য অপেক্ষা করে, তখন শারিবার বদলে চাঁদের আলোয় সে নদীর বালিয়াড়িতে অচেনা ছায়া দেখে। অর্যেক মানুষের ছায়া। অনেক সশস্ত্র মানুষ। তারা ক্রমশ কাছে আসে। তাদের হাতে পনেরো বিশ হাত লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁকানো চাঁদের আকৃতির কোটী হেঁসো, যা দিয়ে দূর থেকে একটি মোক্ষম টানে ধাবমান মানুষের মুণ্ড ধড় ঘেঁকে নিমেষে আলাদা করে যায়, আর যার ব্যবহার ও কৌশল একমাত্র স্থানীয় নোশূদ্রদের মধ্যেই প্রচলিত।
শারিবা মাত্র পঞ্চাশ হাত দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে। সে থেমে একটা ঝোপের পিছনে আশ্রয় নেয়। আট-দশজন সশস্ত্র মানুষ দ্রুত ওমরকে বৃহবন্দী করে ফেলে। ওমরের পিছনে পাতালু নদীর গভীর বাঁওড়। তিনদিকে অগ্রসর মানুষ। ওমরের ভয়ার্ত চিৎকার—‘না’ এবং আরো কিছু অনুচ্চ স্বরবিকৃতি। তারপর মালতীর চিকার। তারপর ওমরের আর্ত চিত্তার ও ছুটে পালাবার চেষ্টা। তারপর ওমরের শেষ চিৎকার এবং তারও পরে ওমরের শেষ আওয়াজ বের হয় নাকের ছিদ্র ও ছিন্ন কণ্ঠনালীর বহির্মুখ থেকে। তারপর দীর্ঘসময় ধরে মালতীর হাহাকার নির্জন নদীতীর, বাঁওড় আর সামনের আগাছার জঙ্গলের ভেতরে আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে।
শারিবা চাঁদের আলোয় একজনকে শূন্যে হেঁসো তুলতে দেখে ও বোঝে ওমরের মুণ্ড ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হল। তারপর সেই ব্যক্তি হাত দুলিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিল মুণ্ডটা। শারিবা মুহূর্তের জন্য চাঁদের দিকে ওমরের মুণ্ডর যাত্রা দেখল। নদীর জলে শব্দ। তারপর দু-জন ঘাতক কবন্ধ ওমরকে দুই হাত ও দুই পায়ে ধরে শূন্যে দুলিয়ে নদীর মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এবার বেশ জোরে শব্দ। এখন আশ্বিন মাস। পাতালু এখন ভরা, টানও খুব জোর। আধঘন্টার মধ্যে ওমরের দেহ ও মুণ্ড এক দেশ পার হয়ে অন্য দেশে পৌঁছোবেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাবে, একথা শারিবাও জানে।
মালতী এখন সংজ্ঞাশুন্য ও ভূপাতিত। ঘাতকরা নদীতে নেমে হাত পা দেহ পোয়। তারপর একজন সংজ্ঞাহীন মালতীকে কাঁধে তুলে নেয়। সবাই চলতে শুরু করে।
৫১-৫৫. আজুরা মণ্ডলের স্বভাবটা কিছু অদ্ভুত
আজুরা মণ্ডলের স্বভাবটা কিছু অদ্ভুত। কিন্তু এখানে কারো চোখেই সেটা বিশেষ লাগে না। প্রচুর জমিজমা আছে অথচ শিক্ষাদীক্ষা কিছু নেই এরকম মানুষের সংখ্যা এ অঞ্চলে কম নয়। এইসব মানুষের জীবনে সম্ভোগের উপকরণও খুব প্রাচীন ও গুটিকয়েক মাত্র। বিরাট ভোজ অর্থাৎ এক বা একাধিক খাসি কেটে লোকজন খাওয়ানো, স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি এবং তার জন্য প্রচুর সময় ও অর্থব্যয়, মদ্যপান আর যাত্রা গান। এর বাইরে ভোগের জীবনের যেসব উপকরণ আছে, আজুরার মতো জোতদারদের কাছে তার কোনো আকর্ষণ নেই। দু-তিনশো একর জমির মালিক আব্দুল্লার ঘরবাড়ির সঙ্গে দশ-পনেরো বিঘার মালিকের ঘরবাড়ির তফাত মাঘ-ফাল্গুন মাস ছাড়া বোঝা যায় না। ঐ সময় আজুরার বাড়িতে ধানের মরাই-এর সংখ্যা থাকে অনেক, দশ-পনেরো বিঘার মালিকের পক্ষে যা কখনোই সম্ভব নয়। তেমনি পোশাক-আশাক, ছেলেমেয়েদের চেহারা, আচার-আচরণ ইত্যাদি কোনো দিক দিয়েই এই সম্পত্তির ফারাক ধরবার উপায় থাকে না।
আর ব্যবধান থাকে এইসব ভোগের ব্যাপারে। আজুয়ার যদি কোনো স্ত্রীলোককে নজরে লাগে ও সে যদি সহজলভ্য হয়, তবে আজুরা সরাসরি তার ঘরেতেই উঠে আসে। একমাসুদেড়মাস সেখানে থাকে, প্রচুর মদ আর চালডাল মুরগা আনায়। বন্ধু-বান্ধবও দু-চারজন জুটে যায়। তাস খেলা হয়। আজুরা এইভাবে একমাস-দেড়মাস একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এই সময় তার গোলার ধান ক্রমান্বয়ে বিক্রি হতে থাকে, ধার বাড়তে থাকে, চাই কি দু-এক বিঘা জমিও বিক্রি হয়ে যায়। যদি সেই স্ত্রীলোক যথেষ্ট লোভনীয় হয় ও যথেষ্ট টাকা-পয়সা খরচ করেও না পাওয়া যায়, আজুরা নিজের লোকজন দিয়ে সে বাড়িতে ডাকাতি করাবে এবং লুঠ করে নিয়ে আসবে সেই মেয়েকে। গোপন জায়গায় রাখবে, নিজের ইচ্ছা পূর্ণ করবে।
কিন্তু পলবির ব্যাপারে এত সহজে নিস্পত্তি হয় না। শারিবার প্রত্যাখ্যানের পর পলবি শান্ত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই নিজের চোখে নিজের ক্ষমতার সীমানা সে দেখতে পায়। তার ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের জীবনে সে পুরুষমানুষ কম দেখেনি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সে যে অসামান্য স্বাধীনতার স্রোতে গা ভাসিয়েছিল, এখন তাকে তার বিকার মনে হয়। এই কয় মাসের জীবন যেন পাঁচবিবির জীবনের থেকেও ঘৃণ্য। আজুরা মণ্ডলকে প্রতিহত করার ইচ্ছা থাকলেও এখন সে বোঝে, বাজিকর গোষ্ঠীতে সে ক্ষমতা কারোই নেই।
কাজেই সে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করে। সে একেবারে শীতল হয়ে যায়। এর জন্য তাকে চেষ্টাও করতে হয় না। শারিবা, প্রত্যাখ্যান তার ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে।
আজুরা তিন দিনে ছ-টা মুরগি আনে, এক বস্তা চাল আনে ও চোলাইয়ের বোতলও আনে গোটা কয়েক। কিন্তু এতেও পলবির চোখে মুখে কোনো উল্লাস সে ফোটাতে পারে না। আজুরা যেহেতু মনে করে মুরগি, চাল ও টাকার বিনিময়ে এসব তার স্বাভাবিকভাবেই প্রাপ্য। না পেয়ে বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এ অত্যন্ত বেয়াদপি তার কাছে।