হঁ, মোর আর কাম কি? বাপ বেটা য্যান দুই ভাই, দোনোজনকে তাতাব।
বাপরে যদি বা পারিস, বেটাকে পারবি না, পলবি।
পলবি ফেস করে ওঠে, ক্যান, শারিবা কোন বারের বেটা যি এত হংকার?
শরমী হাসে। বলে, উয়া ছুবার পারবি না, পলবি। উ আন্দা মনিষ্যি।
ক্যান, উ আন্দা মনিষ্যি ক্যান, শরমী? ক্যান, উ আর দশটা বাজিকরের মত লয়?
শরমী এবার গম্ভীর হয়ে বলে, শারিবা লষ্ট করবি না পলবি, শারিবা হামার বেটা।
ইঃ বেটা! প্যাটের ছাওয়াল!
প্যাটের ছালয়াল লয়, তমো শারিবা হামার বেটা।
মোর কি দোষ? উ ক্যান্ হামার পানে তাকায় না? তোরা ক্যান্ হামা খেদাস্?
এসব কথার পরিষ্কার উত্তর শরমী দিতে পারে না। আবার শারিবার সঙ্গে পলবির সম্পর্কের সম্ভাবনাও সহ্য করতে পারে না। দ্বৈরিণী বৃত্তিকে সব মানুষই সম্ভবত ঘৃণা করে। পলবির স্বেচ্ছাচারের খুব বড় কোনো কারণ এই মুহূর্তে ছিল না।
পলবি বলে, কিন্তু শারিবা হামাক একসময় চাইত।
মিছা কথা।
সি তুই জানো না। তখুন তুই বা কোথায় আর মোরাই বা কোথায়?
পাঁচবিবি থাকতে?
হঁ।
সি সব চ্যাংড়া বয়সের কথা ভুলি যা। এখুন তো চায় না।
তবি কি করমো হামি? কার কাছে যামো?
একথারও কোনো উত্তর নেই শরমীর কাছে। সে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে দৃঢ়স্বরে বলে, সি হামি জানো না। তবি ইখানে লয়, শারিবার চিন্তা ছাড়ান দেও।
কিন্তু এতেও পলবি আশা ছাড়ে না। ওমরের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে অন্ধকারে শারিবাকে ধরে সে।
শারিবা?
কি বেপার?
শারিবার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত এবং বিপন্ন।
শারিবা, হামার কি দোষ?
ই কথা হামা শুধাও ক্যান্?
যদি তুমাকেই শুধাই?
হামার দোষ-গুণের বিচারে কার কী যায় আসে?
যদি কহি, হামার যায় আসে?
পথ ছাড়, পলবি। আমার কাম আছে।
শারিবা, হামার কী দোষ?
নিজের কাছে শুধাও।
মাসে হামা ছিড়া খালো
তাই কি তুমু এখন মানুষ ছিড়া খাও?
পলবিরে ঘিন্না লাগে?
না, তবি ভালও লাগে না।
পাশ কাটিয়ে শারিবা চলে যায়। আর সেই থেকে পলবী নিজেকে আড়ালে রাখে। যখন তখন কেউ আর তাকে বাইরে দেখে না কেউ। এই পরিবর্তনে মেয়েদের থেকে পুরুষরাই অবাক হয় বেশি। পবি যাদের কৃপা করেছিল, তারাই এখন সব থেকে ভয় পায় পলবিকে। কিন্তু যার ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই, সেই আজুরা মণ্ডল বাজিকরপাড়ায় আবার আনাগোনা শুরু করে। কোথাও ফুল ফুটলে তার সৌরভ আজুরীর কাছে ঠিকই পৌঁছায়। আর আজুরাকে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য বাজিকরপাড়ার কারো থাকে না। পলবিরও নয়।
৫০.
ভায়রোর বাইশ দিগর কোলমা ও কাপড়া নমোশূদ্রদের নিয়ে। কোলমা অর্থাৎ যারা লেখাপড়ার কাজ করে এবং কাপড়া, যারা তাত বোনার কাজ করে, এই বাইশ দিগরের অন্তর্ভুক্ত। হালুয়া এবং জালুয়া নমোশূদ্ররা এই দিগরের বাইরে, যদিও তারাই সংখ্যায় অধিক। ভায়রোর বাপ দিগম্বর সর্দার অবস্থাপন্ন নমোশূদ্রদের নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করে এবং হালুয়া ও জালুয়াদের থেকে নিজেদের পৃথক করে নেয়। ভায়রো জন্মগত অধিকারে দিগরের নেতৃত্ব পায় ও দিগরের অনুশাসন আরো কঠিন করে তোলে। কাপড়া নমোশূদ্রদের মধ্যে যারা ছোট ছোট খটখটি তঁত চালিয়ে শুধু গামছা তৈরি করে, তারাও এই দিগরের অন্তর্ভুক্তি পায় না। দিগরভুক্ত মানুষেরা কখনো বাইরে বৈবাহিক ক্রিয়াকর্ম করে না, দিগরবহির্ভূত নমোশূদ্রদের সঙ্গে একত্রে পানাহার পর্যন্ত করে না। কিন্তু এইসব হালুয়া ও জালুয়া নমোশূদ্রদেরও দিগরের অনুশাসন, দিগরপতির আদেশ ইত্যাদি মেনে চলতে হয়। দিগরপতির দেহরক্ষীর কাজ কিংবা দিগরের মর্যাদা রক্ষার জন্য যারা সশস্ত্র বাহিনীর কাজ করে, তারা সদাই দিগর-বহির্ভূত নমশূদ্র। ভায়রো যখন কোনো সামাজিক ক্রিয়াকর্মে যায়, তখন তার ঘোড়ার দুইপাশে চারজন দেহরক্ষী হাতে বল্লম নিয়ে ছোটে। যখন বসে, দেহরক্ষীরা তার দুইপাশে থাকে। ভায়রো যখন কারো মাথা নামাবার কথা বলে, তখন তার মাথা নেমে যায়। এখনো ভায়রো সামাজিক বিচারে উপস্থিত হলে ডালিতে করে নজরানা আসে। সে রাজার মতো সম্মান পায়।
অথচ যদু চক্রবর্তী যখন তার কাছে টাকা ধার নিতে আসে, ভিতরে ক্ষোভ থাকলেও ভায়রো তার সামনে আসন গ্রহণ করে না। যদু বলে, ভায়রো, ঘর থিকা আইনায় নাইমে দাঁড়াও, আমি এটু জল খাই। ভায়রো আঙিনায় নেমে দাঁড়ায়। চক্রবর্তী জল খায়। পুরোহিত বাইশ দিগরের পুজো-পার্বণ করে, কিন্তু ছোঁয়া জল খায় না। বাইশ দিগরের নমোশূদ্রদের বাড়িতে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত পুজো করে না। তাদের পুজো-পার্বণ করে দিগরের অন্তর্ভুক্ত মৈত্র, ঘোষাল, চট্টোপাধ্যায় উপাধিধারী নমোশূদ্ররা। তারা উপবীতও ধারণ করে এবং অশুদ্ধ হলেও মন্ত্র উচ্চারণ করে।
সুতরাং ওমর-মালতীর ঘটনা এত সহজে মিটে যায় না। ভায়রোর বাইশ দিগর এখনো জলচল নয়। মোহর, বাদা-কিসমৎ ইত্যাদি গ্রামগুলোতে ব্রাহ্মণের আধিপত্য নেই বটে, কিন্তু থানা হেডকোয়ার্টারের আধা-শহর সোনামেলায় আধিপত্য ব্রাহ্মণদেরই। যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্ম ব্রাহ্মণদেরই হাতে। সর্বোপরি সমাজের উপরিকাঠামোর বিন্যাস সর্বত্রই একরকম। দিগরের গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এই উপরি-কাঠামোর অন্তর্ভুক্তি ও স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু দিগর এখনো জলচল হয়নি। মাহিষ্য, এমনকি সদ্গোপ অপেক্ষাও নমোশূদ্রের সামাজিক স্থিতি এখনো নিচে। সুতরাং ভায়রো কোনো বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করতে রাজি নয়।