তুই মোছলমান হবি?
কেছু ভাবি নাই।
ভাবার দোরকার নাই।
ভাবার দোরকার আছে, বাপ।
না।
বাপ, আর কুন্ঠি পালাবু?
আঃ!
ভায়রো সর্দার তোর গায়ে হাত দিছে! ভায়রো সর্দার উপা বাজিকরকে চিনে না!
বাপ!
রূপা দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে যায়। শারিবা শঙ্কিত হয়। রূপাকে সে চেনে। সে অত্যন্ত অস্থির রক্তের মানুষ। ভয়ঙ্কর কিছু না ঘটলে সে স্বাভাবিক হয় না।
অনেক রাতে শারিবা রূপা ও শরমীর দ্বৈতকণ্ঠে বিষহরির গান শোনে। দু-জনের কণ্ঠেই নেশার ক্লান্তি। বিষহরির গান বাজিকরেরা গায় না। শুধু রূপা গায়। পলাতক জীবনে নতুন সংস্কার নিয়ে এসেছে রূপা, সেই সংস্কারকে সে রক্ষা করতে চায়। শারিবা শুয়ে শুয়ে গান শোনে, যে গান সে কিছুই বোঝে না, তবু ভালো লাগে।
মেনকা বলে ওগো বাপ
বড় পালু মনস্তাপ
কেনে আইলে বেললি ছাড়িয়া
অমূল্য রতন মোর
ভাসিয়া যায় সাগর–
কি ধন আইলেন বাড়ি লইয়া
তোর যত ধন জন
সপ দেখি অকারণ–
কুড়লে চিরিম তোর নাও,
সুন্দরি বেললি মোর
ভাসিয়া যায় সাগর
ছয় পুত্র মোর নাজুড়া গাও
মৎস্য মকর ঘড়িয়াল
শিশু চরে পালে পাল–
উঠিয়ে মৃত্যু খাইবার আশে,
দেখিয়া বিপরীত
হইবে চমকিত—
পরান জারি তারাসে।
বাপের প্রাণ ধন
মাইয়ের জীবন–
ভাই-এর প্রাণ সোয়াগিনি
হারাইলাম নিধি
আর পাব কৃতি–
চক্ষে বহে মন্দাকিনি।
৪৯.
সব বাজিকর জানে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ কথাটাই ঐন্দ্রজালিক, বুজরুকি। তবুও সব বাজিকরই এখনো রহু চণ্ডালের হাড়ের স্বপ্ন দেখে মনে মনে ও বিশ্বাস করে তার সার্থক অস্তিত্ব সম্ভব।
রহু চণ্ডালের হাড়। তার সঙ্গে সম্পর্ক ঘোর অমাবস্যার। শুধু পীতেম ও জামিরের মতো শারিবা জানে রহুর হাড় লুকিয়ে আছে কোনো এক ভূখণ্ডের ফলপ্রসূ মৃত্তিকার গভীরে, যে স্থানটি বাজিকরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানটি খুঁজে বের করবার জন্যই বাজিকরের এই ভূ-পরিক্রমণ। তার সমস্ত স্থিতি, স্থায়িত্ব, স্বস্তি ও শান্তি হবে সেই ভূ-খণ্ডে। সব বাজিকর নিজস্ব বোধবুদ্ধিমতো সেই হাড় খোঁজে।
কেউ খুঁজে না পেলেও পলবি যেন খুঁজে পায় সেই জিনিস। কয়েক মাসের মধ্যে তার প্রেতিনীর মতো চেহারায় আশ্চর্য পরিবর্তন আসে। রহুর হাড়ের অদৃশ্য স্পর্শে যেন তার শরীরের হারানো সম্পদ ফিরে আসতে থাকে। এত দ্রুত ও অবিশ্বাস্য নিয়মে সে নিজের রূপ-যৌবনকে ফিরে পায় যে লোকে এর পিছনে রহুর ইন্দ্রজাল ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না।
হাড়ের আসল ভেলকি তারপরে শুরু হয়। যেসব রমণী তাকে পরিহাস করত অথবা মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিত, পলবি এখন তাদের স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে খেলা শুরু করে। মর্মান্তিক খেলা। বাজিকরের সমাজে জামির যেসব বিধি-বিধান ও শৃঙ্খলার প্রবর্তন করেছিল, সব যেন তছনছ হয়ে যায়। পলবি তার জীবনের যাবতীয় লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতে থাকে তার স্বজনদের উপর। সমর্থ সব পুরুষকে সে আকর্ষণ করে। এর মধ্যে কোনো গোপনীয়তা সে রাখতে চায় না।
ফলে ঘরে ঘরে অশান্তির অশ্লীল কলহ বাড়ে। বাজিকর যুবকেরা তার স্কুল ঠোঁট, টোল পড়া গাল, ছোট অথচ তীব্র চোখের মধ্যে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাওয়ার আদিম আহ্বান শোনে। পলবি এখন কলহাস্যে কথা বলে, রাস্তা দিয়ে হাঁটে অস্বাভাবিকভাবে, দু-হাত ও শরীরে দোল দিয়ে প্রকাশ্যেই আহ্বানের কটাক্ষ করে প্রত্যেকটি সমর্থ পুরুষকে।
আকালু বলে, শারিবা, রহু চণ্ডালের হাড়ের ভেলকি দেখিছিস?
রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে পলবি হঠাৎ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ, হামা ছাড়ি সব্বাইকে লাগ।
সে অশ্লীলভাবে হাসে।
আকালু বলে, লাগ্যেছে, হামার লাগ্যেছে। কিন্তু শারিবার যি লাগে না পলবি?
পলবির উচ্ছলতা দপ করে নিয়ে যায়। বলে, লাগবে আকালু, লাগবে।
কেরমে কেরমে লাগবে।
তেমনি দুর্বিনীত ভঙ্গিতে সে হেঁটে যায়। শারিবা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। শা-জাদি পলবিকে বলে, এলা হ-ছেটা কি?
কি হ-ছে?
বাপের নাম হাসাছো!
বাপ? মানুষে যখন মোক্ লুটে নিল, তখুন বাপ কুন্ঠি আছিল?
তা এখুনতো ফিরা আছিস, এখন দেখভাল করে বিহাসাদি কর। না, খালি ঘরে ঘরে অশান্তি লাগাছে!
ক্যান, তুমার বেটার সাথ সাদির কথা কছিলাম না? তখন কি কছিলা?
ক্যান? সাতঘাটের জল খাওয়া মাগি মোর বেটা বিহা করবা যাবে কোন দুঃখেত?
তো সাতঘাটের জল খাওয়া মাগি আর ধম্মের কথা না শোনালেই পার। বাজিকরের মেয়ামানষের আবার লাম্বাচওড়া কথা!
থাম্ হারামজাদী ধাম। লয়তো বারুন দে বারায়ে মুখ ভাইঙ্গে দিমো। নিলজ্জ, বেহায়া মেয়েমানুষ! আসে আইজ তোর বাপ
বাপ আইসে মোর করবেড়া কি? মুই বাপের খাই, না পরি? হামা হামার মত থাকবা দি।
শরমী এবং পলবি প্রায় একবয়সী। সেজন্যই হোক, অথবা দু-জনেই রূপসী বলে হোক, কিছুটা অন্তরঙ্গতা জন্মেছিল তাদের মধ্যে।
শরমী বলে, খালি চাইখে বেড়াছেন, ইবার আন্ কথা ভাবেক।
আন্ কথা?
থিতু হবার কথা।
দুনিয়ার মাষে এত্তোকাল হামাক চাখল, এখুন মুই তারাদের ছাইড়ে দিমো?
তো কি করবি? ঘর ঘর আগুন লাগাবি?
তোর ঘরেতো লাগাই নাই।
সাহস আছে?
ডর দেখাস না, শরমী। উপা বাজিকর এখুনো বুড়া হয় নাই।
হঁ, বাপও জুয়ান, বেটাও জুয়ান, কান্ ধরবি?
শরমী পলবির চোখে চোখে তাকিয় থাকে। শারিবা সম্পর্কে পলবির দূর্বলতার কথা অজানা নেই কারো কাছেই।