সালমা বলে, মানুষটা লোভী ও বজ্জাত।
পীতেম বলে, তাতে তোর কি? তাতে বাজিকরের কি আসে যায়? পয়সা তো রোজগার হচ্ছে!
তুই আজকাল খুব পয়সা চিনেছিস। ভকত আর বেনিয়াদের মতো খালি পয়সার চিন্তা তোর।
পয়সা ছাড়া দল বাঁচবে না, তুই আমিও বাঁচব না।
ভয় হয়, এর পরে তুই কবে আবার ঘর-গেরস্থালির কথা ভাবতে শুরু করবি দলের জন্যে?
ঘর-গেরস্থালি? বাজিকরের?
নয় কেন? পয়সা চিনছিস না?
কি জানি? বাজিকর কেন পথে ঘোরে? বাজিকর কেন ঘর বাঁধে না? এসব আমার মাথায় আজকাল আসে মাঝে মাঝে।
আসে, না?
আসে।
ঘর বাঁধবি? তারপর রাতের পর রাত, সারাজীবন সেই এক ছাউনির নিচে থাকবি?
থাকলাম।
এক পুকুরের জল খাবি সারাজীবন?
খেলাম।
চেনা পথ হাঁটবি সারাজীবন?
হাঁটলাম।
কোন মানুষটা হবি তুই? দয়ারাম ভকত, না তার ঐ বাঁধা চাকরটা যার ঘাড়ের উপর পা রেখে ভকত ঘোড়ায় উঠল?
সালমা!
হাঁ, হাঁ, বল?
এত ভাবি নাই।
দলের সর্দার তুই, পীতেম, তোর ভাবা দরকার। বাদিয়া, বাজিকর, বানজারার জীবনে তো সবার জন্য একই রকম রাস্তা। কিন্তু এই গেরস্থের রাস্তা সবার আলাদা।
হাঁ, সেটাই ভয়। গেরস্থ হওয়া মানে বাঁধা জানোয়ার। আর জানোয়ার বাঁধা থাকতে তাকে দোয়ানো সোজা। দুইয়ে তার শেষ বিন্দু রক্তও বের করে নেওয়া যায়।
তবুও তুই বাঁধা জানোয়ার হওয়ার কথা ভাবছিস?
ভাবছি।
কেন?
বাজিকর-বাদিয়ার দিন বোধহয় শেষ হয়ে আসল। পশ্চিম থেকে পুবে এই যে ক্রমান্বয়ে হেঁটে যাওয়া, সেই পুবদিকের সীমানা বোধহয় অন্য কোনো পশ্চিমে গিয়ে ঠেকে যাবে।
কিন্তু দেখ, বাজিকরের পালাবার রাস্তা থাকবে না, সব রাস্তা সাহেবরা রেল দিয়ে বেঁধে ফেলেছে, দেখছিস না?
দু-জনেই খুব সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। দু-জনের ঝোক দুই বিপরীত মেরুতে, কিন্তু মজা এই, কারো কেঁকই খুব দৃঢ় নয়। শীতেম স্পষ্টত মানুষগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু সালমার তেমন কিছু নেই। তার কাছে স্থায়িত্ব খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়, আবার চলমানতাও এখন আর খুব ছন্দময় মনে হয় না।
অতঃপর তারা তাদের এই বহির্জগৎ সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়। যদিও বাজিকরের জীবন পরিশ্রমহীন নয়, তবুও সতত উৎপাদনশীল জীবনযাত্রা তার অপরিচিত না হলেও, তার বিধি-উপকরণ সম্বন্ধে তার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই।
যেমন পীতেম বলেছিল বাঁধা জানোয়ারকে দোয়ানো সহজ, এই বিষয়টা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দশ বছরের মধ্যে দোহকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে হাটে বাজিকরে সামান্য পণ্য বিক্রির সময়ও ভাগিদার এসে উপস্থিত হয়। দালাল যেন মাটি খুঁড়ে বের হয়। এমনকি নিতান্ত খেলা দেখিয়ে যে ভিক্ষাবৃত্তি, যা বাজিকরের একান্ত নিজস্ব, সেখানেও ভাগ দিতে হয়। ভাগ দিতে হয় দারোগা পুলিশকে, ভাগ দিতে হয় স্থানীয় বদমাশদের।
যেমন বাজিকর ভাবে, কেবলমাত্র যাযাবরই জীবনকে সঠিক জানে বা জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করে। এ ভাবনা ঠিক কিনা, এখন এরকম সমস্যা কারো কারো মগজে আসতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে সালমাকে এক সন্ন্যাসী বলেছিল, ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও, কেননা পাপ অধিক হলে এই দৃশ্যমান পৃথিবী ধ্বংস হবে। তখন পুণ্যাত্মারাই রেহাই পাবে, পাপীরা নয়।
সালমার ধারণা হয়েছিল, এ লোকটা তার রূপে মজেছে, তাই এসব তাকে দলে ভেড়াবার ফন্দি। সে হেসেছিল এবং অবজ্ঞা দেখিয়ে চলে এসেছিল। অথচ পরে অনেক চিন্তা করেও বুঝতে পারেনি, কী আকর্ষণে ঐ লোকটার কাছে সে গিয়েছিল। সে নিজে মানুষের হাত দেখে এবং ভূত-ভবিষ্যৎ বলে, ছক পেতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে, নিদান দেয় শুভ এবং অশুভের, কিন্তু এসবের সঙ্গে বাজিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত এতকাল তো ছিল না।
এই চমৎকার নিসর্গ, পিছনের গঙ্গা, যেখান থেকে বছরের এই সময় যখন খুশি দমকা হাওয়া উঠে এসে আছড়ে পড়তে পারে, নিয়ত-সঞ্চরণশীল নৌকোগুলোকে সন্ত্রস্ত করতে পারে। অথবা দুরের ঐ পাহাড়, এখন কী চমৎকার ঝকমকে, সবুজ মুহূর্তে তার রঙ বদল করতে পারে সম্পূর্ণ বিপরীতে। তবুও এই মুহূর্তে প্রাণবন্ত ও রঙিন এইসব প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর যদি উঠে দাঁড়ানো যায়, তাহলেই ডান পাশের আমবাগানটার ভেতরেই চোখে পড়বে কুৎসিত বিবর্ণ সব মালখানা, আড়ত ও অস্থায়ী চালার সারি। যেখানে হরদম মাল এবং মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে, কুৎসিত আওয়াজ, ঝগড়া, হাসি ও কখনো কখনো দাঙ্গা এইসব প্রবহমানতায় মিশছে। অথবা, আরো একটু এগিয়ে, যেখানে ভারি মহাজনি ও গয়নার নৌকোয় মাল উঠছে। বিচিত্র সব পণ্য। খেত থেকে আসা, মানুষের উদ্ভাবনীতে ও নৈপুণ্যে বাস্তবায়িত শ্রম—ধান, তৈলবীজ, পাট অথবা, বস্ত্র, শিল্পসামগ্রী, অথবা আধারে আবদ্ধ পণ্য, এমনকি বধের জন্য নীত পশুর দঙ্গল এবং ক্রীতদাস ও বেশ্যা হওয়ার জন্য ক্রীত ও সংগৃহীত মানুষ। এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত মানুষ, যে ঘাম ফেলছে, যে হিসাব রাখছে, যে মস্তিঙ্কে লাভের অঙ্ক কষছে। এই যাবতীয় চাঞ্চল্য নিয়ে এক পৃথক জীবনযাত্রা। কোথায় অধিক উত্তাপ, জীবন, মুক্তি?
যেমন ধন্দুর মা বলেছিল, তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে। অথচ পীতেম অন্যদের সহায়তায় বাজিকর রীতিতে গর্ত খুঁজে শুধুমাত্র মানুষটাকে সমাহিত করেছিল। মাটি দিয়ে গর্ত বোঝাই করেছিল। তারপর দল নিয়ে আবার পথে বেরিয়ে পড়েছিল। সবকিছুই যেমনকার তেমন ছিল, তেমনিই চলছিল।