সময়ের স্রোত অনেকখানি রাস্তা পেরিয়ে এসেছে। জামির বাজিকরের তৃতীয় পুরুষ শারিবা নিজেকে কখনোই এখন আর যাযাবর ভাবতে পারে না। শ্রমের মধ্যে নিয়োজিত অস্তিত্বকে সে বিপন্ন দেখতে পারে, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে আর ভবঘুরে কল্পনা করতে পারে না।
অন্ধকার আরো গাঢ় হলে প্রায় সবাই আসে রূপার আঙিনায়। ইয়াসিন বলে, এমুন দিন এসবে, জানতাম। বুঢ়াগুলা তো আগেই বলি গিছে। তুমার বাপ বলিছিল, বাজিকরের বেটারা, জানবার হয়ো না। তা ইবার বোধহয় বাজিকর জানবারই হোই যাবে। একজন তরুণ বলে, ক্যান্? বাজিকরের ধরম নাই! এভোবড় দুনিয়ার বেবাক মানষিক হয় ভগবান, লয় আল্লা, লয়তো যিশু বানাইছে। তো ই বাজিকরগুলো কি এংকা আসমান ফুড়া বারাইছে? আরেকজন বলে, বাজিকরের বিটি পাট খ্যাতে চিৎ করা চলে, বাজিকরের বিটি লুঠ করা চলে, ঢেমনি বানাবার চলে, আর বাজিকরের ব্যাটাক্ জামাই করা চলে না।
আঃ থাম্। শরমের কথাগুলো নিয়া চিল্লাইস না!
নাঃ চিল্লাবে না, নুক্ করে থাকবে!
হাঁ নুক করে থাকবু, হারামজাদা। চিল্লায়ে কুত্তি যাবু? মোনোৎ নি, পাঁচবিবি ঠেঙে কুত্তাখো কেমন হলু?
শুধু রূপা চুপ করে থাকে। শারিবার গায়ে হাত দেওয়ার ব্যাপারটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। তার চোখে রক্ত ঝলসে উঠছে বারবার। আঃ শারিবা, ডায়রো সর্দাবোক ছাড়ান নাই। সে মনে মনে এমন চিন্তা করছিল। তার যাযাবর রক্ত তাৎক্ষণিক চরিতার্থতা চাচ্ছিল। পাঁচবিবির রক্তাক্ত স্মৃতিতে সে তর্পণ করেছিল এবং তার স্বভাব অনুযায়ী ঘটনার গতি ধরে আগাম চিন্তা করতে সে রাজি ছিল না।
ইয়াসিন এবং তার সমবয়সীরা রূপাকে চেনে। রূপার নির্বাক ছটফটানি তারা দেখে ও শঙ্কিত হয়। পাঁচবিবির দগদগে ঘা এখনো শুকোয়নি।
রূপা কেছু কতা কও না যি?
কি কমো?
দশঝনে বসি এ্যটা বিহিত কেছু করবা হয়।
কি বিহিত করবা? ভায়রো সর্দারের সাথ বিবাদ করবা?
ভায়রোর সঙ্গে বিবাদ! পাগল না হলে একথা কেউ ভাবে না।
না, বিবাদ লয়—
তবি কি আশ্নই?
ওভাবে কথা হয় না। রূপার মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ। শারিবা বলে, মামা, খেসের হাজি এটা কথা কলেন। কথাটা ভাবা লাগে।
কি কথা, বেটা?
হিন্দু সমাজ হামরাদের নেবে না, কেন্তু মুছলমান সমাজ নেবার পারে।
কেম্কা?
কলমা পড়ে মুছলমান হলো—
খবরদার, শারিবা, ওলা কথা মুখে আনবুনা। হামি হিন্দু, হামার ঘরোৎ বিষহরির vট আছে, হামার বেটা হয়্যে তুইও হিন্দু।
রূপা ফুঁসে ওঠে। তার অজ্ঞাতবাসের জীবনে সে হিন্দুসঙ্গ করেছে, হিন্দু মেয়েকে নিয়ে এখন ঘর করছে। তার সংস্কারের মধ্যে হিন্দুত্ব ঢুকে গেছে। সে বিষহরির গান গায়, ঘটপূজা করে, রাজবংশীদের কালীপূজা এবং গম্ভীরার উৎসবে যোগদান করে। শারিবা চুপ করে থাকে।
কিন্তু ইয়াসিন বলে, ক্যান্ মুছলমান হলে দোষ কি। তমো, এটা কোট ধরা থাকা। শালো বাজিকর, শালো বেজাত’ আর শোনবা হবু না। বেটাবেটিগুলা বিহার ঘর পাবু, হামরা পামো সমাজ।
এতো সস্তা লয়, এতো সস্তা লয়।
লয় সস্তা তো, আত্রাই হয়লো। কেরমে কেরমে হোবে। মুছলমানের ঘরে ঝামেলা কম, বাছবিচার কম। হামারদের পড়তা হোবে।
বাদবিতণ্ডা এবং কোলাহল শুরু হয়। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে। ভিড়ের মধ্যে কখন একসময় ওমর এসে স্থান নিয়েছে কেউ টের পায়নি। সে বলে, আমার কি হোবে, ইয়াসিন চাচা? আমি তো মরে গেলাম। কেউ একজন তাকে উপদেশ দেয়, তুই মোছলমান হোই যা, ওমর। তবি ভায়রো আর তো ছোবার পারবু
আর মালতী?
তাকও মোছলমান বানা।
শারিবা বলে, সিটা হোবার লয়। বাজিকর মোছলমান হোবার পারে, মালতী পারে না। ক্যান?
আঃ হা!
তবি?
নাজবাব।
তবি আমি কি করছো? পাঁচকুন, হামাক্ বাতায়া দ্যান। পালায়া হামি কতদিন বাঁচমো? কি খামো? কুথা যামে?
কী আফসোস! যে সমাজে কোনো বন্ধন নেই, সেখানে কে কার দায়িত্ব নেয়? যে যার নিজের জ্বালায় জ্বলছে অহর্নিশ, অন্যের হেপা কে সামলায়?
ক্যায় কইছিল তুমাক্ হিদুর মেয়ার সাথ পিরিত করবা? শালো হারামজাদা, নিজে ম-লি, হামরাদেরও মজালি!
ক্যান, কি খারাপটা করলু হামি?
খারাপটা করো নাই শুয়োরের বাচ্চা, বাজিকরের ঝন্যি দোতলা দালান বানাবার বেবস্থা করিছ।
চড়ের শব্দ, চিৎকার। ওমরের ভাঙা গলায় আক্ষেপ।
তুমরা হামা তাড়ায়া দিবার চাছেন, চাচা? কুন্ঠি যামো হামি?
যিথায় খুশি সিথায় যাও। মোহরের ই বসতিৎ আগুন জ্বলবার আগে ভাইগে যাও।
হাঁ ভাইগে যাও, হামরা তুমার খিদমৎ করবা পারমো না। এক উপা বাজিকরের মদ্দানিৎ পাঁচবিবির বাস উঠল হয়, কোত্তোগুলা পরান গেল, আর লয়, আর পারমা না।
তোর পাও ধরি চাচা, হামা মারা করিস না। হেই শারিবা হামা বাঁচা।
বাঁচামো তুমা? হারামজাদ, হিদুর নাং পুষার সখ হইছে তুমার!
অন্ধকারের মধ্যে প্রহারের শব্দ। ওমরের আর্তনাদ। সব মিলিয়ে সবাই বুঝতে পারে ওমর সত্যিই কতখানি সর্বনাশ ঘনিয়ে এনেছে। বুঝবার বয়সের সবার স্মৃতিতেই পাঁচবিবি এখনো জীবন্ত। আর একবার নয়, আরেকবার কিছুতেই নয়। কয়েকজন নির্মম হয়ে ওঠে, অন্যরা নির্বাক হয়ে থাকে, বাধা দেয় না, ওমর মার খায়। শারিবা তুই হামা বাঁচাবু বলিছিলি। তুই হামা দেখলু না। শারিবা মুখ নিচু করে থাকে। ওমর অন্ধকারের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যায়।
ওমর চলে যেতে একটা স্তব্ধতা নামে, একটা লজ্জা ও বিষাদের স্তব্ধতা। শুধু একজন রমণী বিনিয়ে কাঁদে, সে ওমরের মা। একে একে সবাই চলে যায়। অন্ধকারের মধ্যে শারিবা আচমকা রূপাকে লাড়িয়ে উঠতে দেখে। রূপা দ্রুত সপরিবার কাছে আসে।