পরদিন শারিবা ভায়রোর কাছে যায়। অনেকক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কেননা সকালের এ সময়টা ভায়রো বিনোদ সরকারের কাছ থেকে রেহানির হিসাব বোঝে। হিসাব বোঝা শেষ করে বাইরে আসে না। হঠাৎ শারিবা ভয় পায়। ভায়রো সর্দারের চেহারাটা বিরাট। লম্বা কঁচাপাকা চুল পিছনে খোঁপা করে বাঁধা। কপালে লম্বা সিঁদুরের তিলক। চোখের দৃষ্টি এত তীব্র, মনে হয় ভিতর পর্যন্ত দেখে ফেলছে। প্রথম প্রশ্নতেই সে বিপন্ন হয়ে পড়ে।
খোঁজ পাওয়া গেছে?
শারিবা চুপ করে থাকে। ব্যাপারটা সে গোপন রাখতেই মনস্থ করেছিল। কিন্তু এখন যেন মনে হচ্ছে এই ভীষণ লোকটা মুহূর্তেই সব কিছু বুঝে ফেলে।
কুন্ঠি আছে।
শারিবা আরো দুর্বল হয়ে যায়। তার গা ঘামে, হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
রাও কাড়ে না, ঠসা নাকি?
ভায়রো গর্জন করে ওঠে। যেন বাঘের সামনে শারিবা, যেন বুদ্ধি নষ্ট শারিবার। সে স্থির হবার চেষ্টা করে। ভায়রোর চোখের দিকে তাকায় চোখ তোলে। চোখ নামায়।
খোঁজ পাই নাই, মালিক। শারিবা কথাটা বলে, একটু সাহস ফিরে পায় যেন। একটু দম নেয়, তারপর আবার বলে কেন্তু খোঁজ পালেও মুশকিল, মালিক। আজুরা মণ্ডল টাকা দিবার রাজি হচ্ছে নাই।
হা-রা-ম-জা-দা।
ভায়রো চুলের মুঠি ধরে শারিবার। মাটি থেকে টেনে শূন্যে ওঠাতে চায় যেন।
হারামজাদা, মিছা কথা আমার কাছে!
একটা চড়ে শারিবার মাথার ভেতরের সব কিছু নড়ে যায় যেন। কোথাও মাথার শিরা-উপশিরায় সাপের ছোবল লাগে তার।
কুন্ঠি আছে?
শারিবাকে ছেড়ে দিয়ে দৈত্যের মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ভায়রো। শারিবা এবার সোজাসুজি তাকায়। তার চোখের যাযাবরী হল্কা আগুন কাঁপছে।
হামার জানা নাই, মালিক।
জানবা হোবে। আজ ছাড়ি দিলাম। দু-দিনের মধ্যে খবর চাই।
শারিবা কয়েক পা পিছিয়ে আসে, তারপর হাঁটতে থাকে। ক্রমশ তার হাঁটা দ্রুত হয়, তারপর সে ছুটতে থাকে। সমস্ত শরীর তার অপমানে জ্বলছিল। সে দিশেহারার মতো দৌড়াচ্ছিল সামনের দিকে। কোথায় যাচ্ছে, কোনো কাণ্ডজ্ঞান
৪৮.
বাদা-কিমৎ একটি যুক্ত গ্রাম। এর বাদা অংশে নমোশূদ্রদের প্রাধান্য আর কিসমৎ অংশে মুসলমানদের। নমোশূদ্রদের যেমন ভায়রোই একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী মানুষ, মুসলমানপাড়ায় তেমন নয়। সেখানে বেশ কয়েকজন অবস্থাপন্ন গেরস্থ আছে। তার মধ্যে দু-ঘর হাজি। দেশভাগের ফলে বেশ কয়েক ঘর গেরস্থ ওপারে চলে গেছে জমি বদল করে, সেখানে কয়েকঘর হিন্দু এসেছে। এতে মুসলমানপাড়ায় মুসলমান প্রাধান্য কিছুটা কমেছে। ভালো অবস্থার কোনো গেরস্থই দেশ ত্যাগ করেনি। উভয় সম্প্রদায়ের স্মৃতিতে সান্তাহার রেলস্টেশনের দাঙ্গা এখনো গোপন ত্রাস।
কিসমতের হাজি খেসের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। নদীতে ওজু করতে গিয়ে সে শারিবাকে নির্জনে বসে থাকতে দেখে। কায়িক পরিশ্রমে যারা বেঁচে থাকে, এরকম আধ্যাত্মিক নির্জনতা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক নয়।
কে তুমু, বাপো?
শারিবা, শারিবা বাজিকর।
চোখে পানি ক্যান, বেটা?
চোখের জল এরপরে আর কোনো বাধাই মানে না। হাজি শারিবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
দেশভাগের পর সমষ্টিগতভাবে মুসলমান এদেশে দুর্বল হয়ে গেছে। উপরন্তু, ওপার থেকে যেসব হিন্দুরা এসেছে তাদের আক্রোশ ও জ্বালা নিভবার কোনো লক্ষণ নেই। উসকানি দেবার লোকের অভাব কোনোদিন কোথাও হয় না। হাজি খেসের সমাজপ্রধান হিসাবে সদাই শঙ্কিত থাকে। শারিবাকে সে বোঝায়, ইসলামে জাতপাতের বালাই নেই। কাজেই বাজিকর মুসলমান হলে ধর্ম পাবে, সমাজ পাবে, স্বজন পাবে। পড়ে পড়ে মার খাওয়ার কিবা অর্থ হয়। তুমার বাপকে বল, ইয়াসিন সর্দারকে বল, সব বুঝ করি রাজি হওতো মৌলভী বুলা করাই, কলমা পড়ার ব্যবস্থা করি।
একজন বিধর্মীকে ইসলামে দীক্ষিত করলে হজ্জের সমান পুণ্য। কিন্তু হাজি খেসের-এর নজর সেদিকে নয়। স্বজন কমে গেছে, বাড়বে না, কিন্তু স্বধর্ম বাড়বে।
শারিবা বলে, ওমর-মালতীকে কলমা পড়াবা পারবেন, হাজিসাহেব?
মালতীর কথায় ভেসের বিপন্ন বোধ করে। দিগরপতি ভায়রোর সঙ্গে বিরোধ করতে যাওয়া কোনোমতেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মালতী-অপহরণ বৃত্তান্ত এ অঞ্চলে সবাই জানে। তার সঙ্গে ভায়রোর শর্তের কথাও জানে। এসব ব্যাপার ক্রমশ বেশি বেশি করে সম্মানের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ভায়রোর রোখ বাড়ছে। এতক্ষণ শারিবার সঙ্গে কথা বলে খেসের এসব বুঝতে পারে।
মালতীকে ছাড়বা হোবে, বেটা। তুমরা মুসলমান হলে কেরো কেছু যাবে আসবে না, কেন্তু মালতীর বেলায় কি কথা খাটে না।
ক্যান্?
তার সোমাজ আছে, নিয়ম আছে।
হামার নাই?
দুঃখ করে না বাপো। নিজের কাছে শুধাও!
ওমরের কাছে যাওয়া হয় না শারিবার। কী আশ্বাস নিয়ে যাবে? খেসেরকে বলে, আপনার কথা বাপোক্ কমো, সর্দারোক্ কমো।
সন্ধ্যার পর অন্ধকারের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে পাড়ায় ঢোকে শারিবা। শারিবা ভায়রোর কাছে মার খেয়েছে, ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই এখবর চাউর হয়ে যায়। রূপা সহ কয়েকজন তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। শারিবা ফিরতে রূপা নির্বাক হয়ে বসে থাকে। শারিবার মুখ নিচু কতকাল আগে জমির বাজিকর মার খেয়েছিল? পাটখেত নিড়ানি ঠিকমতো দিতে না পাড়ার জন্য মার খাওয়া, মোষের পায়ে চোট দেওয়ার জন্য মার খাওয়ার সঙ্গে আজকের মার খাওয়ার তফাতটা সবাই বুঝতে পারে। তার সঙ্গে যেন একটা অপরাধবোধ ছিল, যা মানুষকে অনেক অত্যাচারও মেনে নিতে সাহায্য করে। আরো ছিল জামিরের রোখ।