চার ঘর ব্রাহ্মণের মধ্যে তিন ঘরই বর্তমানে ভূস্বামী। চার ঘরই এখানে ভাগ্যান্বেষী হয়ে এসেছিল। মাত্র এক ঘর এখনো যজমানী করে, অন্য তিন ঘর সম্পন্ন গৃহস্থ। সবারই সম্পদের উৎস যজমানী এবং সুদের কারবার।
এছাড়া প্রত্যেক গ্রামেই আছে কয়েক ঘর করে সাঁওতাল কিংবা ওরাওঁ বসতি।
এই বিন্যাসে যে যার নিজস্ব বৃত্তে থাকে। ব্রাহ্মণ ও কায়েতরা যেহেতু সংখ্যায় কম, কাজেই অন্যদের সঙ্গে সামাজিক বিরোধ এড়িয়ে চলে। সবচেয়ে শক্তিশালী ভায়রো তার সমাজের বাইশ ‘দিগর’-এর মাথশ। দিগরের মজলিশ কিংবা জমায়েতে সে এখনো বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে পুরুষানুক্রমিক ক্রোধ প্রকাশ করে। বন্নাল হামরাদের জাত মারি রাখি গিইছে। হামারা তো জাত-মরা ছিলাম না। বল্লাল হামরাদের সাথ আঁটবা পারছিল না, তাই জাতে মারে। শোনা যায় তার পাঁচ হাজার বিঘা জমি। অবশ্যই তার সম্পদের মূলে মাথা হিসাবে এই বাইশ দিগর ও তার বাইরের নমোশূদ্রদের শোষণ। কিন্তু জাতপ্রীতি তাকে তার দিগরের সঙ্গে একাত্ম রাখে ও সম্প্রদায়ের মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রভৃতি অক্ষুন্ন রাখে। নমোশূদ্র হিসাবে হীনমন্যতা নেই। সে কারণেই আরো অনেকের মতো সে ‘সরকার’ কিংবা ‘দাস’ হয়নি, এখনো মণ্ডলই আছে। অবশ্য মণ্ডল থাকার একটা সুবিধা এই, জলচল মাহিষ্যদের থেকে অজানা লোক তাকে পৃথক করতে পারে
ওমর নামে বাজিকরদের একটি তরুণের সঙ্গে নমোশূদ্রপাড়ার মালতী নামে একটি মেয়ের গোপন প্রণয় হয়। অবশেষে যুগলে পালায়, কেননা তাদের সামনে স্বাভাবিক পরিণতির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। নমোশূদ্র যুবকেরা বাজিকরপাড়া তছনছ করে এবং শেষপর্যন্ত মালতীকে না পেয়ে ইয়াসিনকে ধরে নিয়ে আসে ভায়রোর কাছে।
ভায়রোর সমাজ যদিও ‘জলচল’ নয়, তবুও তার বিরাট বিস্তৃতি আছে। কাজেই ঠিক মহিমবাবু কিংবা লালমিয়ার মতোই সেও জানতে চায়, তোমরা হিন্দু, না মুছলমান। সেই পুরনো প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন, যাকে বাজিকর সিঁদুরে মেঘের মতো ভয় পায়।
ভায়রো আবার বলে, তুমার ঘরের এটা ছেড়া হামার ঘরের এটা ছেড়ি নিয়া পালাবা পারে, ইকে বয়সের দোষ, কি, বয়সের গুণই কবা পার। কেন্তু সিটা কথা লয়, বড় কথা হল, তুমরা হিন্দু না মুসলমান?
এ প্রশ্নের উত্তর বাজিকর দশ বছর আগেও দিতে পারেনি, এখনো পারে না। ইয়াসিন চুপ করে থাকে।
ভায়রোই আবার বলে, কোন বল্লাল তুমাদের জাত মারোছে, হামার জানা নাই। তবি মারটা বড় কঠিন বটে। এ
ইয়াসিন জানত, নমোশূদ্র উচ্চবর্ণের হিন্দুর কাজে বেজাত। সে শেষপর্যন্ত একটা মুখের মতো আবেদন করে, হামরার্দের আপনার জাতে তুল্যে লেন, মালিক। শুন্যাছি আপুনি দিগরের মালিক সমাজ আপনার কথা শোনবে।
ভায়রো প্রচুর হাসে। বলে, বাইশ দিগর হামা নমোশুদদুর বানাবার হক্ দেয় নাই বাজিকর। হিন্দুধর্মে এমুন হক্ কেরো নাই। তুমু ব্রাহ্মণ, কায়েৎ, মাহিষ্য, সদ্গোপ, নমোশুদদুর কেছুই হবা পারবা না। তুমু ইসব জাতের হয়া জন্মবা পার, হবা পারো না।
ইয়াসিনের সঙ্গে বাজিকরপাড়ার কয়েকজনও এসেছিল কর্তব্যের খাতিরে। তাদের মধ্যে থেকে শারিবা এগিয়ে এসে বলে, সবই তো বোঝনো, মালিক। এখুন বিচারটা করবা হয়।
ভায়রো লঘু পরিহাস ছেড়ে তার দিগরের নেতৃত্বের ভূমিকায় মুহূর্তেই ফিরে আসে। গলা চড়িয়ে বলে, বিচার হামার করাই আছে। মেয়াক খুঁজি আনা করাও আর উ মেয়ার বিহার যা খরচা লাইগবে, তা উ বাজিকরের বেটা জরিমানা দিবার হোবে।
কথা বলে লাভ নেই। তবুও শারিবা বলে, মালিক, বাজিকর নেংটা গরিব। ভিখ মেঙ্গে খায়। অত্তো টাকা কুন্ঠি পাবে? ইবারটা মাপ করি দেন।
টাকা দিবে আজুরা মণ্ডল। সি তো তুমাদের বসত করাইছে। তবি কি কড়ারে দিবে সিটা তার সাথ বুঝ কর।
কি শর্তে আজুরা টাকা দেবে, তা জানে শারিবা। জানে অন্য সব বাজিকরেরাও। মুখ নিচু করে ফিরে আসে সবাই। শেষ চেষ্টা, আজুরা যদি মধ্যস্থতা করে ভায়রোর সঙ্গে।
কিন্তু আজুরা তাতে রাজি হয় না। ভায়রো সর্দারকে সে ভালোমতোই চেনে, ভয়ও পায়। আর তাতে তার লাভই বা কি?
দিনসাতেক পরে রাতের অন্ধকারে ওমর শারিবার কাছে আসে।
শারিবা, হামাক্ বাঁচা।
শারিবা চুপ করে থাকে।
আকালু বলে, তুমার বাঁচন নাই।
শারিবা, হামরা বাঁচা।
এবার শারিবা চোখ তুলে তাকায়।
মেয়াটা ফিরোৎ যাবি না?
না শারিবা, না!
তোর সাথ থাকবি?
মাইরে ফালালেও মালতী ফিরোৎ যাবি না।
ভায়রো অংকা হোবার দিবি না। ভায়রো তোর লাশ ফেলি দিবি। আকালু বলে, ভায়রোর জাতের অহঙ্কার বড় ভোয়ানক!
দিগরপতি ভায়রো নিজের জাতের মধ্যে কোনো বেচাল সহ্য করবে না। দিগরের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তার রেহানি কারবার। সুদ আদায়ের ব্যাপারে সে নির্মম, কিন্তু তার সামাজিক অনুশাসনও মানতে হয় তার জাতের প্রত্যেকটি লোককে। শারিবা এ সমস্যার কথা আগে বোঝেনি। মালতীর ফেরত নিয়ে যে সমস্যা দাঁড়াতে পারে, একথা সে চিন্তা করেনি। আছিস কুন্ঠি?
দহের ভাঙা নৌকায়।
ওমর ফিসফিস করে বলে। মাইল দুয়েক পুবে জনহীন প্রান্তরের মধ্যে অনেকখানি অঞ্চলকে ভেঙে বাঁক নিয়েছে। পাতালু। পাতালু সেখানে গভীর। জেলেদের দু-খানা ভাঙা নৌকা সেই বাঁকে পড়ে আছে। সাপের ভয়ে মানুষ সেখানে যায় না! ওমর সেখানে লুকিয়ে থাকে মালতীকে নিয়ে।
খাস কি?
একবেলা মাও যায় নুক্কে।
আজ ফেরৎ যা। কাল আমি যাম।