তো কি? দুদিন গোহালের পাছুৎ মইরে পড়ি ছিল। বাস ছড়াতে সোব্বার খ্যাল হয়। ইথে তোর কি? হামার? এর থেকে বেশি আলোড়ন মোহরের বাজিকরপাড়ায় পলবি আর তুলতে পারে। দু-দিনে সুখী বুড়ির চোখ নাক ছুঁচো আর পিঁপড়েতে খুবলে খেয়েছে। অথচ সুখী ত বিশ বছর চৌধুরীবাড়িতে খলালির কাজ করেছে।
হেথায় খাবি কি?
ক্যান কাজ কইরে খামো।
অথচ পলবি জীবনটাকে বাঁধবার কথা কি মনেও ভাবে না? বাজিকরপাড়ায় একজন পুরুষও কি সে পাবে না? কিছুদিন স্বস্তিতে থাকলে কি সে পুরনো দিনের এমন কিছুই ফিরে পাবে না? এখন নসিবনকেও তার ঈর্ষা হয়, যে নসিবন তার দ্বিগুণবয়সী এক পুরুষমানুষের ঘর করে। যে নসিবন তার নিজস্ব দু-টি জারজ ছাড়াও আরো তিনটি কংকালসার মনুষ্যসন্তানকে সামলায়।
ফলে কয়েকমাসের মধ্যেই সে বাজিকরপাড়ায় সমস্যা সৃষ্টি করে। তার মানসিক জগতে শনিবারের ভূমিকম্পের থেকেও জোরালো কোনো ভূমিকম্প মারাত্মক ভাঙচুর করে দিয়ে গেছে। বিপর্যস্ত জীবনকে আবার যাহোক কিছু একটা গ্রহণযোগ্য পরিণতিতে আনতে শ্লীলতা, শিষ্টাচার ও বিচারের মধ্যে রাখে না। বিপর্যস্ত বিচারবোধে বাজিকরপাড়ার কোনো সমর্থ পুরুষমানুষই তার আহ্বান থেকে বাদ যায় না, এমনকি আকালুও নয়, এমনকি সামর্থ্য যার প্রান্তিক সীমায়, এমন মানুষও নয়।
পুরুষেরা প্রথমে সহানুভূতিতে তারপর বিরক্তিতে তাকে এড়িয়ে যায়। মেয়েরা প্রথমে তার দুঃখে সহমর্মিতা বোধ করত, তারপর তাকে রসিকতা করত, শেষপর্যন্ত তারা তাকে মর্মান্তিক যন্ত্রণা দেওয়া শুরু করল।
পলবি শা-জাদিকে ধরে, তুমার ব্যাটাক বল হামা বিহা করবা।
আচমকা এরকম প্রস্তাবে শা-জানি একটু হকচকিয়ে যায়। তারপর বলে, তুই-ই বল।
হামার নাজ নাগে।
কেন্তু শারিবা তোর ছোটই হবে, লয়?
য়েঃ, অত্তোবড় জোঁয়া!
হামি বয়সের কথা ক-ছি, পলবি।
ছোট হোবে নাঃ, সোমান সোমানই হোবে।
এটা কি আমার বলা ঠিক? ছাওয়াল জুয়া হইছে না?
ছাওয়াল তুমার, তুমু ছাড়া কবে ক্যায়?
ঠিক আছে, ছাওয়ালের বাপে বলি দেখম।
তখনকার মতো নিষ্কৃতি পায় শা-জাদি। সেদিন বিকেলেই সে রূপার বাড়িতে আসে।
শারিবার বাপ ঘরেৎ আছে?
শরমী খেজুরপাতার চাটাই বিছায়।
বসে দিদি, বসেক্।
শা-জাদি বসে। বলে, না বুন, বসার সোমায় নাই হামার। সিদ্ধ ধান শুকাচ্ছে হামার, কুটবা হোবে।
রূপা এলে সোজাসুজি শা-জাদি তার মুখের দিকে তাকায় না। একটু পাশ হয়ে থাকে। বলে, এতোদিন তো ঘুরি বারালে বাজিকর, ছাওয়াল হামি পালনো।
ঘুরি বারাই নাই, শারিবার মাও, পালাই বারাছি।
হঁ, সিতো দেখবাই পাছি। একা পালাই বারানোতে জুত হচ্ছিল না, তাই কার ঘরেৎ সিধ কাটি চিড়িয়া ভাগালেন আর দোকা হলেন হয়।
রূপা বলে, ই দেখেন, ই দেখেন, এলা কথা এখুন আবার ক্যান। ছাবাল কুন্ঠি বা আছে। ইসোব কথা কানে গেলে শরম যাবি।
হুঁ, ছাবাল শরম যায় যাক, বাপের শরম না গেলেই হয়, লিলাজ বাজিকর!
হাটে মেলায় যে রূপা অমন লম্বা বক্তৃতা করে, এখন একেবারে কোণঠাসা হয়ে যায়। শরমী খালি হাসে। রূপা বলে, এই দেখেন, মেয়া মানষির মুখেৎ আগল নাই।
তো সি যাক, এখুন কথাটা কি শুনি?
ছাবালের বিহা দিবার হোবে না? সিটাও হামি দেখম?
হঁ তো, সিটা তো ঠিকেই। তো নওরিঁ দেখ।
নওরিঁ হামি দেখম’ আর লতুন ‘বিয়ের’ ঘরে তুলবো তুমু বাজিকর? লতুন ‘বিয়ের’ তুমার সেবা কইরবে, যতন কইরবে, তুমু কোলে শোকর লাচাবা, লয়? বাজিকর এমুন স্বার্থবাদী হয় বটে!
না, না, আমরা সোব্বাই খোজম।
কুন্ঠি? বাজিকরের ঘরে ময়া নাই। যি ক-টা আইবুড়া আছে তারাদের মাওবাপ আগভাগেই বেটার বাপদের সাথ কথা করি রাখিছে। তা-বাদে আরো পাঁচটা আবিয়াৎ জুয়া আছে, তার মাঝে হামার শারিবা এটা। ইয়াদের নওরিঁ কুন্ঠি জুটবে? ইসোব হিসেব হামার করা সারা।
তবি তত ভারি গোল!
ই গোলের লিদান হামি দিম? ছাবালের যতদিন মাও ছিল, ছিল। মাও গেল তো বাপ আলো তালুই হ-য়া। শারিবার কপালে বুঝি আর নওরিঁ জুটল না, হায়!
হঃ ভারি আমার বুঝদার হছেন। মেয়র আবার অভাব! এমুন জুয়া বেটা হামার বিটিগুলা হামলাচ্ছে—
মুখেৎ আগল আঁটেন, বাজিকর। কথা যিটা বলনো, খ্যাল রাখেন আর সর্দারের সাথ শলা করেন। ই ক-বছর বাজিকরপাড়ায় বিটি ছাবালের মড়ক চইলছে। অনেকগুলা মেয়া এবার ওধার হোই গিছে। হিন্দু সমাজ হামরাদের লেয় না, মোছলমান সমাজও হামরাদের লেয় না। কুন্ঠি যাম’ হামরা? ইসব কথা এখুন ভাবা করেন, বাজিকর।
ওঠার আগে শা-জাদি শরমীকে বলে, তুমাক এটা কথা বলি যাই, বুন। পলবি আবাগী বড় ছোঁক ছোঁক করবা লাগিছে। ছাবালের খোরৎ ও আগুবা দিবা না।
৪৭.
মোহর গ্রামে চার ঘর মাত্র ব্রাহ্মণ, ছয় ঘর কায়েত, নতুন বসতির বাজিকররা বাদ দিলে বাকিরা সদগোপ, মাহিষ্য ও কৈবর্ত। কৈবর্তদের মধ্যে আবার দুই ভাগ আছে, একদল হালুয়া, অন্যদল জালুয়া। একমাত্র জালুয়া কৈবর্ত্যরাই ‘জলচল’ নয়। অবশ্য বাজিকরদের বিষয় একেবারেই স্বতন্ত্র। মোহরের পাশের বাদা-কিসমৎ নমোশূদ্র ও মুসলমানপ্রধান গ্রাম। বাজিকরদের বসতি এই দুই গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায়, দুই গ্রামেরই প্রত্যন্তে। নমোশূদ্ররাও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে জলচল নয়, কিন্তু বাদাকিসমতের ভৈরব মণ্ডল ইত্যাদি কয়েকজন নমোশূদ্র বেশ বর্ধিষ্ণু এবং দাম্ভিক। ভৈরবের বা ভায়রোর কয়েক পুরুষের রেহানি কারবার, এখনো তেজি। ভায়রো এখনো ঘোড়ায় চড়ে মহালে যায়।