পাঁচ টাকা লয়, তিন টাকা লয়,
দুটাকা লয়, এক টাকা লয়,
কেবল বারো গণ্ডা পয়সায়
সি মাদুলি—
মোনৎ রাইখবেন খালি মাদুলির দাম—
গাছরার লয়
খালি বারো গণ্ডা পয়সা।
ই হামার শেষ কথা।
তবি ভদ্দর নো—(হো ) ক—
হামি মরা মানষি বাচাবার পারি না।
হামার ওস্তাদ রামলাল গারোলী,
কড়ি চালান দি’
সাপ ধইর্যে আনে।
সাতদিনের সাপকাটি বাসি মরা
জিয়ায়!
তবি ভদ্দরনোক,
আপনাদের দোয়া মাঙ্গে রূপা বাজিকর।
ওস্তাদের সাচ্চা চেলা য্যান্ হোবার পারি।
তারপর শরমী ঝাঁপির ঢাকনায় তাবিজ ফেরি করে, ফাউ হিসাবে ক্রেতার সঙ্গে দুই একটা রঙ্গরসের কথা বলে। এদিকটায় ব্যাপারটা খুবই অভিনব। মানুষ দেখে মুখের কাছে তাবিজ ধরলে, গাছড়া ধরলে অমন কালান্তক গোমা, আলা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর সাপকে ডরায় না কে? মানুষ বারো আনা পয়সা খরচ করতে পিছপা হয় না। রূপার রোজগার ভালোই হয় তিন বছরের পলাতক জীবনে সে সঞ্চয় করেছে এই নতুন পেশা, খেলা ও তার সঙ্গে এই পাটোয়ারি বুদ্ধির ব্যবসা। চেহারা তার চিরকালই আকর্ষণীয়। এখন সেই চেহারাও তার কাজে লাগে। বাজিকর সাপ নাচায় না, জামির একথা বলেছিল কোন এক প্রাচীন কালে। তারপর জামির একথাও বলেছিল, থিতু হওয়ার জন্য সব কাম করবা হোবে। রামলাল গারোলী তার গুরু ঠিকই। শুধু সাপ ধরা আর সাপ খেলাই শেখেনি রূপা তার কাছ থেকে, শিখেছে আরো অনেক কিছু। সাপ ধরো, রামলাল শেখাত, লোহার শিক গরম করা ধরো তার মুখোৎ, সাপ তার স্বভাব দোষে খুবলাবে সি গরম শিক। একবার, দুবার, পাঁচবার। তা-বাদে? তা-বাদে তার মুখোৎ খ্যাংড়ার কাটি ধরো, মুখ ঘুরায়ে লিবে সি। ইবার তুমি সি ছাইপাশ দি তাবিজ বানাও, মাদুলি বানাও, মানষি কেনবে।
আকালু বলে, বাপ তোর বেপসাটা ভালই শিখ্যেছে।
ব্যাপসা ক্যান? অযুদের দাম লগিচ্ছে না, খালি মাদুলি।
হঁ রে শারিবা, এক সিক্কার মাদুলি বারো আনা। মানুষ অংকা বোকা লয়, বুঝে সবাই।
তবি লেয় ক্যান?
লেয় সাপের ডরে। যা মানুষ যত ডরায়, তা মানুষ তত দেখবা চায়। সাপের চ্যায়ড়ার দিকি তাকা, চোখ ফেরাবা পারবু না। কি চিকন কালা দ্যাহখান! মাজা তুল্যে য্যামন দাঁড়ায়, চোখ আঁকায়া দেখ জানওয়ারটা—কেমন রাজা রাজা দেখায়। লয়?
সিটা ঠিকোই। তবি বাপের অষুদের কুনো গুণ লাই?
বাপকে শুধা।
শুধোতে হয় না। সাপের আকর্ষণ মানুষের কাছে তীব্র। সে আকর্ষণ শারিবাও এড়াতে পারে না। কাজেই রূপা যখন তাকে বলে, সাপ ধরাটা শিখ্যে লে, সে এগিয়ে আসে। তারপর রূপা তাকে প্রথমেই সাপের গতিপ্রকৃতি বোঝায়, মাথা হেলানোর অর্থ বোঝায়, আঘাতের তীব্রতার মাত্রা বোঝায়। রূপা বোঝায় আর শরমী হাতেকলমে দেখায়, ই দেখ বাবু, ভাল করি নজর করি দেখ, উরাৎ পাশে হিলালে সাপ কী করে আর উপর-নিচ হিলালে সাপ কী করে। ই দেখ বাবু, সাপ ক্যান্ গলা ফুলায়, না দম ল্যায়, দম ভরে বুকোৎ, ইবার পুরা মার মারবে, পুরা জোরের মার।
রূপা বলে, সোরন রাখ শারিবা, একহাত খাঁড়া মাজা তো দ্যাড় হাতত পুরা বিষ ঢালবে, দুহাত ফণা উঁচু তত তিনহাত তক পুরা খুবলাবে।
তবি উ তাবিজ গাছরা কুন্ কামে লাগে?
রূপা হাঁ করে থাকে, শরমী খিলখিল করে হাসে।
ওলা তোর জন্যি লয়, ওরা যারা সাপ লাচায় তাদের জন্যি লয়, বাপ। যারা সাপ দেখলি বিশ হাত দূরে পালাবে, ওলা তার জন্যি।
শারিবা সাপ নাড়াচাড়া করতে শেখে, নাচানো শেখে, ধরা শেখে। রূপা পুরো বাজিকর মহল্লায় একটা নতুন আলোড়ন আনে। পয়সা রোজগারের নানান ফন্দিফিকির খোঁজে বাজিকরেরা। আজুরা মণ্ডলের জমি খালাস হয়। শা-জাদি ইয়াসিনের ঘরেই থাকে ও সম্ভবত তার শেষ সন্তানের জন্ম দেয়। আজুরার রাখনি নসিবনও পরপর দুটি সন্তানের জন্ম দেয় ও ক্রমে হতশ্রী হয়ে আজুরার কৃপা হারায়। তবুও তার মহত্ত্ব কীর্তিত হয়, কেননা নতুন খালাসি জমির দু-বিঘা সে নসিবনকে দলিল করে দেয়। সেই শক্তিতে বলীয়ান নসিবন খুবলাল নামক এক বিগতদার বাজিকরের ঘরে ওঠে।
৪৬-৫০. রূপার পরে পলবি ফিরে আসে
রূপার পরে পলবি ফিরে আসে। কিন্তু পলবির আর লুঠ হবার মতো চেহারা থাকে না। বিগত সাত আট বছরে সে এত বেশি লুঠ হয়েছে যে এখন আর ছিচকে চোরও তার দিকে হাত বাড়াতে রাজি নয়। তার দাম্ভিক যাযাবরী মুখমণ্ডল এখন আর হাসিতে গালে টোল ফেলে না। চোখের চাহনি মুহূর্তেই উচ্ছলতা ছুঁড়ে দেয় না। তার চেহারায় ছিল অসামান্য আকর্ষণ, সহজাত বন্যতা, যার জন্য সে একসময় সদাই সন্ত্রস্ত থাকত। এখন সে নির্ভর।
এই সময়ের মধ্যে সে তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এইসব সন্তানেরা দিগিন মণ্ডলের, মহিমবাবুর, মহিমবাবুর শালা হেলার, না লালমিয়ার তা সে নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না। বলার প্রয়োজনও আর নেই। কেননা একজনও দু-বছরের বেশি বাঁচেনি। শেষপর্যন্ত সে লালমিয়ার বাড়িতে খলালির কাজ করত। ওখানে থাকার শেষ তিনবছর। খলান পরিষ্কার করা, ধান ভানা, ধান শুকানো, গোয়াল কাড়া, এসব খলালির কাজ।
তখন দিগিন মণ্ডল ছিল না, মহিমবাবু ছিল না। পাঁচবিবিতে তখন একা লালমিয়ার রাজত্ব। সান্তাহার রেলস্টেশনের দাঙ্গার পর লালকুন্ঠি লুঠ হয়, মহিমবাবু পালিয়ে বাঁচে। দিগিন মণ্ডল অসম বিনিময়ে এপারে এসে যা জমি পায় তাতে হীনবল হয়ে পড়ে।
তমো তো সেথা খাবা পাতি। হেথায় আলু ক্যান্?
ডরে।
ডর! আর কি ডর?
সুখী বুড়ি যি মরি গিল হয়।