তারপর যখন জুম্মনের ঘোলাটে চোখের কোণা ফেটে রক্তের ফোটা জমে, কান থেকে গড়িয়ে নামে রক্ত, মুখের কষে ফেনা, যখন সে শেষবারের মতো গোঙায়, হেই মাও, তোর মুখ দেখি না ক্যান? তখন শা-জাদি বাঁধ ভাঙে। হাহাকার ধ্বনি যার কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই, এমন শব্দ। যা রাত্রিকে খান খান করে। যাবতীয় আবদ্ধ যন্ত্রণাকে একবারেই ছড়িয়ে দিতে পারে সমস্ত পৃথিবীতে এমন নিরেট সিসের টুকরোর মতো ভারি শোক।
তারপর সেই শতাধিক মানুষ একসঙ্গে সন্তাপ করে। সাররারাতব্যাপী অভুক্ত, ক্লান্ত শোক। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের অসংখ্য রুদ্ধ নিরূপায় শোক এখন গতিশীল হয়। যে রাত শেষ হয়ে কখনো সূর্যোদয় হয় না, যে রাতের অন্ধকার শুধু লবণাক্ত জলে ভাসিয়ে দিতে হয়, সেইরকম রাত পার করে দেয় এইসব মানুষ।
শারিবা? জুম্মন?
নাই। সাপকাটি হয়্যা মরিছে।
ক্লান্ত মোষটা ঘাসে মুখ দেয়। শারিবা মুখ ঘুরিয়ে আবার চলে, পিছন ফিরে তাকায় না। যেন তার পিছনে কেউ নেই। যেন তার কোনো অতীত নেই। যেমন বাজিকরের যে-কোনো অতীত জামির ভেঙে ফেলে শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রেখে গেছে তার বংশধরের জন্য।
৪৫.
চারিদিকে হাটুরে মানুষের ভিড় গোল হয়ে। মাঝখানে ছ-টি সাপের ঝাঁপি। একটির মুখ খোলা। তার ভেতর থেকে মাথা তুলে আছে এক বিশালকায় গোক্ষুর, স্থানীয় ভাষায় গোমা। রূপা ঢোলকে কাঠি মারে, ঘুরে ঘুরে ভিড়ের বৃত্তকে বড় করে। শরমীর কাপড় হাঁটুর উপরে তোলা। পায়ের চেটোয় ভর দিয়ে বাঁ উরু আন্দোলিত করে গোঙ্কুরের সামনে। যুবতী নারীর ভরাট উরু। মানুষের ভিড় বাড়ে। গোমা তার উত্তোলিত দেহ বাঁকা করে পিছন দিকে, আরো পিছনে। শরমী হাতের মুদ্রা করে। গোমা ছোবল মারে, শরমী হাঁটু সরিয়ে নেয় এবং একই সাথে বাঁ হাতে সাপের গলার নিচে হাত দিয়ে সাপকে প্রতিহত করে। একটা পূর্ণবয়স্ক গোক্ষুরের ছোবলের শক্তি মাঝারি শক্তির ঘুষির মতো। শক্ত মাটিতে ছোবল আছড়ে পড়লে সাপ জখম হবে। শরমী বলে, খা—খা—খা, বক্কিলাক্ খা, কিপ্লুনাক খা–।
রূপা ঢোলক রাখে। মাথার রঙিন ফেট্টি খুলে আবার নতুন করে বাঁধে। রক্তাভ বিশাল তার চোখ, পাকা গমের মতো গায়ের রঙ, বলিষ্ঠ চেহারা। অচিন মানুষকেও সে আকৃষ্ট করতে পারে। ঝুলির ভেতর থেকে একটা শুকনো শিকড় সে বের করে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ঢঙে সে বলে, এই যে ভদ্দরলোক—ইয়ার নাম মণিরাজ গাছ। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে স্বরগ্রাম উঁচুতে নিচুতে উঠিয়ে নামিয়ে সে অনর্গল কথা বলে। যে-কোনো শব্দের সঙ্গে যখন তখন একটা বিসর্গ যুক্ত করে সে তার পেশাদারি ঢঙটি বজায় রাখে।
ইয়ার নাম মণিরাজ গাছ।
আস্তক মুনি কামনা মণিরাজ সাপের মাথায় মণি।
মহাভারতের ফরমাঃ ন।
হামার ওস্তাদ আপার আসামে থাকেন—
কামরূপের লোক উনিহ্।
জাতে গারো লোক—
না (হা)ম—রামলাল গারোলী।
বয়স—একশৎ পঁচিশ বছ্ছর।
তবি এটাই কথা মোনৎ রাইখবেন,
ভদ্দর নোক—
দুইটা, চাইরটা পয়সা সাপ দেখায়া হামি
রোজগার করবা চাই নাঃ।
হামার একটাই দাবি, ভদ্দর নো(হ)ক,
ওস্তাদের হুকুম—
বছরে দুই মাস হামি বিনা পয়সায়
সাপ দেখায়া বেড়াই।
মাত্তুর দুই মাস।
আর এই মণিরাজ—
ভদ্দরনো-হোক,
ডাক্তারে, ওষুধে, কবিরাজে
কাম হয় না।
সাপকাটি দংশন ঘন্টা পারাবে না,
জানা আছেঃ—
বজিৎ-সাপেৎ জঙ্গলে লড়হাই—
তাবাদে বেজি ডাক্তার কোবরাজের কাছে যায়?
নাঃ
যায় এই গাছরার কাছে।
মণিরাজের শিকর,
ওস্তাদের আদেশ—হুকুম—
ভদ্দরনোক মাফ কইরবেন,
কুনো পয়সা দি’ লয়,
ওস্তাদের হুকুম।
ইয়াই হামার শ্যাষ কথা।
তবি এটা কথা মোনৎ রাখেন,
ই গাছরা আপনার বেবাক বেমারি ভাল করবা পারে নাঃ।
খালি সাপকে দূরে রাখবা বারে—
এই গাছরা।
ভদ্দরনোক—
আপনার ঘরোৎ এঁদুরে বড় বড় গত্থ করে—
যম আসে, আপনার যম!
বেবাক ভাই জানেন,
আততাৎ ঘষরর আঁগনাৎ শোওয়া ভাই জানেন,
কানের নিচে মাটির নিচে
সর্সর্ শব্দ করি যি যায়—
সি আপনার যম।
কেন্তু রূপায়?
নাই।
মাটির ঘরে গত্থ হবেই।
এঁদুর বসবেই।
সাপ এসবেই।
সি সা—(হা)প-
মানষির গায়ের গরমে ডিম পাড়ে,
সি সা—(হা)প-
দুই থিকা দু হাজার হোবার পারে।
আর অসাবধানে—
আপনাক কাইটবে।
এক ঘড়ি যাবে না—
তার আগে এ–ই সাপের রঙ পাবে আপনার চামড়া।
আস্তক মুনি, মণিরাজ
সাপের মাথায় মণিঃ–
এই গাছরা–
আপনার ঘর বাইনধবে,
সাপকে রাইখবে দূরে দূরে
আপনা বাঁচাবে।
আ (হা) র—
যি সব বাচ্চা চেংড়া শোকর শুঁকরি,
ঘুম গেলে দাঁত কিড়মিড় করে,
মুখ দিয়া জেলা তুলে,
ভদ্দর নো–(হো)–ক,
এই গাছরা মাদুলি কইরে
লয়।
ভরা কলসির এক বদনা জলোৎ
একবার, খালি একেবার চুবায়া
সি জল পিলাবেন সি চ্যাংড়াক্।
আর হামার জুঁয়া ভাইদের,
এটা কঠিন বেপার আছে।
আততাৎ ঘুমির মধ্যে—
শয়তান যার ঘাড়োৎ চাপে,
মোনৎ শয়তান ঢুকে বসে,
সি জুঁয়া ভাই, কু স্বপন দেখে,
যাক্ হামরা কহি–খারাপ স্বপন।
ই গাছরা ধারণ কইরবেন, আইজ্ঞা।
ই হামার শেষ কথা।
তবি মোনৎ রাইখবেন,
তামা, সীসা, দস্তা, সোনা, রূপা,
হাঁ, সব ধাতুর মাদুলি চইলবে।
ওস্তাদের হুকুম।
না, মাফ কইরবনে আইজ্ঞা,
পয়সা নিই না।
ওস্তাদের হুকুম দুই মাস,
আর ই গাছরা এংকাই দি,
পয়সা নিই না
তবি যদি বলেন,
সি মাদুলি কইরবা গেলে
আপনার খরচ লাইগবে তিন টাকা, পাঁচ টাকা।
ভদ্দর নোক, গরীব ভাই,
আপনার হুজ্জতি রেহাই,
ঠগবাটপাড় রেহাই,
মণিরাজ আস্তক মুনি কামনা, মহাভারতের ফারমা(ঃ)ন
হামার ওস্তাদ—
এই গাছরা যা জানে খালি বনের বেজি,