যাযাবর বলে, হেই, কবি গাছ ঢেঙা হোবে, তা-বাদে তার পাত ঝাপরা হোবে, তবি সি গাছে ঘেঁয়া হবে। ওলা আমার কাম লয়।
জামির সেই যাযাবরকে শাসন করেছিল।
আবার সেইসব অনুশাসন যা বাজিকরকে অর্থহীন ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাইত, জামির তাও ভেঙেছিল।
হেই তুমি বিটি ছেল্যা হয়্যার কাপড় নাইড়ে দিয়া আন্ জাগাৎ গেছ, আন কাপড় পিনধে আইছ, তুমার সামাৰ্জ বন্ধ হইল। হেই জামির, তুমু ইয়ার দণ্ড দেও। ইয়ার সাজা বিধান কর। (
না, ইয়ার দণ্ড হয় না। অংকা বিচার হয় না। মাঠ-ঘাট-রাস্তার বিচার মাঠ-ঘাট-রাস্তা—রাইখ্যে আসিছি। এখুন ঘর-জমিন আর ফসলের বিচার, লতুন বিচার, লতুন আইন।
অনেকে আহত হয়, আশঙ্কিত হয়।
আবার সেই জামির মতিনকে বলেছিল, না, পাসরা, তুমার বুনের বিটি, উয়া তুমু বিহা কইরবা পারবা না।
তবি হামি কাক বিয়া করছো? হামার বিহা হোবে না?
তুমু আন মেয়া খোঁজ, মতিন। পাসরা তুমার আপন বিটির পারা, তাক বিহা করা সাজে না।
সমস্যাটা তখনই জটিল হয়ে উঠেছিল। বাজিকরের ছেলেমেয়ের বিয়ের সমস্যা সবাইকে ভাবাচ্ছিল। অকালমৃত্যু বাজিকরদের দ্রুত সংখ্যা হ্রাস করছিল। কাজেই উপযুক্ত সময়ে পাত্রের পাত্রী ও পাত্রীর পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া লি-লাঙ্গল-জমি নিয়ে যে সমাজ তাতে বিয়ে একটি বিশেষ ব্যাপার। বিয়ে সমাজকে প্রশস্ত করে, পরিধি বাড়ায়। সবচেয়ে বড় কথা, বিয়ে কম হোক বেশি হোক, জমিকে নাড়াচাড়া করায়, কর্মী লোকের জমি বাড়ে। কিছু থাকলে তুমি খেটে তাকে বাড়াতে পার। সামান্য কিছুও পরিশ্রমের তেজে তাপে বাড়ে। কিন্তু আদিতে তো সেই সামান্য কিছু চাই। কিছু-না থেকে কিছু-না-ই বেরোবে। জামির এসব বুঝত। বুঝত, অন্য সমাজের সঙ্গে কুটুম্বিতা চাই। যাও মতিন, অন্য সমাজের বিটি বিহা করি আন।
কিন্তু সেসব জামিরের স্বপ্নই থাকে। পার্শ্ববর্তী কোনো সমাজের পাত্র বা পাত্রীকে বাজিকর ছুঁতে পারে না। দুর্লঙ্ঘ্য বাধা দূর করতে পারে না কেউ। অতি কদাচিৎ কেউ নিজ বাজিকর পরিচয় গোপন করে দূর থেকে বাজিকরের থেকেও হা-ঘরে নিরম্ন ঘরের মেয়ে নিয়ে আসে। জানাজানি হওয়ার পর অশান্তি হয়, দাঙ্গাও হয় কখনো কখনো। শেষপর্যন্ত জামিরকে অতি দুঃখে নিদান দিতে হয়, বাপসকল, জানবার হয়ো না। অর্থাৎ কন্যাস্থানীয় কিংবা পুত্রস্থানীয়কে বিয়ে কোরো না। চেষ্য রাখবা, যাতে বিটিরা দূরে যায় আর বেটারা দূর থিকা আনে। শোগর, মরি আর ইওয়া—জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহ এই তিনকে হিসাবের মধ্যে রাখ, নিয়মের মধ্যে রাখ।
আর জামির বলত, বাজিকরের বেটারা, তুমরা বাদিয়া বটে, কেন্তু সি কথা এখন বিসসারণ হই যাও। আঁছোতে লোই লাচাবা না। না করবা মাথা গরম। কেন কি ইটা আমাদের থিতু হোবার সোমায়। মাথা ঠাণ্ডা রাখ বাপসকল।
তথাপি দেখ শারিবা, আমি কি কাজ করানো। হামার বাপ জামির বাজিকর কত বুঝার আদমি ছিল। হামি বাজিদের থিতু উচ্ছেদ করনো। হামি বাজিকর বালবাচ্চাকে মারা করনো। ই স আমার দোষে রে শারিবা। আর ই দেখ, এখুন পালাই বেড়াই। হোথা যাই, হেথা যাস, ফির বুঝি বাদিয়া বনে যাই। ই হামার সদাই ডর।
না, তুমার সি ডর নাই। দেশ ভাগ হোই গিছে। সি দ্যাশের আইন সিথাই থাকি গিছে। ওলা আইন হেথায় আর তুমাক ছোঁবে না।
হাঁ, সিটা বুঝেই ফিরনো। এখুন ইয়াসিন হামা রাখে, হেথা থাকমা। লয়তো চলি যাবো, ফির বাজিকর হোই যামো।
রূপা শা-জাদির কথা একবারও জিজ্ঞেস করে না। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় বলে বোধহয় ছেলের কাছে সংকোচ লাগে। শারিবার পর শা-জাদি আরো তিনটি সন্তান রূপাকে উপহার দিয়েছিল, তার একটিও এখন আর বেঁচে নেই। শেষটির, জুম্মনের মৃত্যু হয় পাঁচবিবি থেকে পালানোর সময় রাস্তায় সাপের কামড়ে। রূপা এখনো সে কথা জানে না। মোষের পিঠের উপরে ঝোলানো সাপের ঝাঁপিগুলোর দিকে শারিবা যতবার তাকাচ্ছে ততবারই কথাটা তার মনে হচ্ছে। জুম্মন এখন থাকলে বছরদশেকের হতো। শারিবা আশঙ্কা করছে কখন রূপা প্রশ্নটা করে।
হাঁ শারিবা, জুম্মনরা কেকা আছে?
শারিবা থমকে থামে, অথবা সে থামে না, কেউ তাকে থামায়। সে আগে আগে চলেছিল, অন্যরা পিছনে। সে ফিরে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি আবিষ্ট, দূরবর্তী।
পাঁচবিবি থেকে মোহরের পথে এখন তার অস্তিত্ব। একটা পরিত্যক্ত মাঠকোঠা শাড়িতে তাড়া-খাওয়া মানুষগুলোর রাতের অবসন্ন আশ্রয়। অভুক্ত ঘুম। ভাই, হামাক্ কিসে কাটল? হায় ভাই, হামার হাত জ্বলি যায়।
শারিবা লাফ দিয়ে উঠেছিল। অন্ধকার বর্ষণসিক্ত রাত! মাটির মেঝেতে ধাবমান ইদুরের ভয়ার্ত চিৎকার। তার সঙ্গে ধাবমান সাপের ক্রুদ্ধ গর্জন। কি অন্ধকার। ভাই, কিসে কাটল হামাক? হায় ভাই, হামার হাত জ্বলি যায়।
দিগিন মণ্ডল তাড়া করেছিল রূপাকে। তার হাতে ছিল দেড় মানুষ দৈর্ঘ্যের একটা বল্লম, যার ধাতব অংশটাই ছিল এক হাত। রূপা পালিয়েছিল।
খাদ্য ও খাদকের মধ্যে হঠাৎ পড়ে গিয়েছিল জুম্মনের ঘুমন্ত হাত। কালাত্মক যম ভেবেছিল এ বোধহয় এক প্রতিবন্ধকতা। হায় ভাই, হামার হাত জ্বলি যায়।
কাঠখড়ির আগুনটাকে উসকে তুলেছিল শারিবা। তারপর জুম্মনের দ্রুত কিন্তু চার ঘন্টাব্যাপী মৃত্যু। ভাই, আমার সারা গাও রবশ লাগে ক্যান? মাও, হামাখ ধইরে উঁচা কর। হামি কেছু দেখবা পাছি নাই ক্যান?
শতাধিক মানুষ নিঃশব্দে ঘিরে রাখে জুম্মনকে, কেউ কোনো শব্দ করে না। যেন শব্দেরও মৃত্যু হয়েছে। যেন সবাই নিঃশক্ত ঐক্যমত হয়েছে নৈঃশব্দ্যে। যেন শুধু শব্দ ও ধ্বনি উচ্চারণ করবে এখন জুম্মন, যেহেতু আর কোনোদিন সে বাতাসের বিরুদ্ধে তরঙ্গ তুলবে না।