শারিবা আজুরা মণ্ডলের পতিত ভিটা জমির উঁচু নিচু মাটি চটিয়ে সমতল করো অন্যদের সঙ্গে এবং বিশ্রামের সময়ে এসব চিন্তা করে। এখন তার বয়স বিশ বছরের কাছাকাছি। শক্তসমর্থ যুবক শরীর তার। সে চিন্তা করে, কেননা লুবিনি তার ভিতরে চিন্তার বীজ বপন করে গিয়েছিল। সে বোঝে চিন্তা সবাই করো না, চিন্তা কাউকে কাউকে করতে হয়। জামির বাজিকর চিন্তা করেছিল, লুবিনি চিন্তা করেছিল, শারিবা এখন চিন্তা করে।
একপাশে গাছের তলায় তার প্রায় সর্বসময়ের সঙ্গী আকালু বসে থাকে। আকালু তাদের সঙ্গেই দেশান্তরী হয়েছিল। সে পরিশ্রমের কাজ করো না, অথবা করতে পারে না। তার শরীর শীর্ণকায়। এখনো সে হাপু গায় এবং বাজিকরদের কাছে শেখা নানারকম হাত সাফাইয়ের খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে।
আকালী বলে, চ্যাতনে আছিস, শারিবা? কি ভাবিস সদাই?
না, ভাবি না।
পলবির কথা?
থাম শালা বেজাত! খাম্কা একোই চিন্তা।
অথচ চিন্তাটা খামোখা নয়, এবং জানে একমাত্র আকালুই। যে বয়সে শারিবা পলবির দৃষ্টিতে শিশু। সর্বত্রই, সব সমাজেই অষ্টাদশী পলবিরা মোল বছরের শারিবাদের শিশু ভাবে। অথচ এরকম ঘটনা হয়, সব জায়গাতেই।
আকালু বলে, ইয়াসিন তোর মামা লাগে না?
শারিবা ইঙ্গিতটা বোঝে। মাথা নাড়ে। এ শুধু তাদের দু-জনার অন্তরঙ্গ সংলাপ, শুধু তাদের দুজনার।
তোর মায়ের আপন চাচেরা ভাই?
শারিবা নিশ্চুপে মাথা নাড়ে।
তোদের মাঝে একা হয়, হামারদের বম্মনদের এমকা হয় না।
হামারদেরও এলা আগে হোত না। এখন হয়, রূপায় কি?
তোরা তো হামারদের সাথ কুটুম করবি না। মুসলমানরাও করবে না। বাজিকরের ঘরোৎ বিয়া-সাদি ঝকমারি হোই গিছে।
ক্যান? আজুরা তোদের সাথ কুটুম করলো লয়?
কুটুম? ওলা কুটুম কয়? আন্ লোকের কথা ছাড়, আকালু। তুই বিহা করবি বাজিকরের বিটিক?
হামি? তোর মাথা খারাপ? হামাক কোন মেয়া বিহা করবে?
ক্যান? মেয়ার অভাব?
না না, সিটা কথা লয়। হামাক ভাল করি দ্যাখ, ভাই শারিবা। হামাক যি মেয়া বিহা করার চাবে, তাক হামি কেমকা বিহা করমো?
ক্যান?
শারিবা ধরতে পারো না রহস্যটা।
হামার জুটি যি হবি শারিবা তাক কোন মরদ বিহা করবার চাবে?
মজাক ছাড়, আকালু। সিধা কথা ক। বাজিকরের মেয়া বিহা করবি?
হামার তো জাত নাই। হামি বেজাত। কেন্তু হামাক্ দি কি আসে যায়?
পলবি নিখোঁজ হয়, নসিবন ঢেমনি হয়, শা-জাদি তার চাচেরা ভাইয়ের ঘরে উঠে যায়। শিশুমৃত্যু, অকালমৃত্যু বাড়ে। একই রক্তের মধ্যে বারবার মিশ্রণ হয়। উপায় কি! নিদান দেওয়ার মতো বয়োবৃদ্ধ কেউ বেঁচে নেই।
এরকম একদিন অতি ভোরবেলায় শারিবা পাতালু নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারে সূর্যোদয় দেখে। ওপারে নদী একসময় পুব থেকে পশ্চিমে বয়ে আসত, এখন গতিপথ পরিবর্তন করে উত্তর থেকে দক্ষিণে এসে এই জায়গায় পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে। ফলে পুবের পরিত্যক্ত চড়া এখন দীর্ঘস্থান জুড়ে বালিয়াড়ি, প্রায় উদ্ভিদশূন্য। সূর্য ধীরে ধীরে ওঠে, সেই বালিয়াড়িতে নানাবর্ণের প্রতিফলন ফেলে। বালির উপরে জমে থাকা শিশিরবিন্দু ঝলমল করে। শারিবার এই সূর্যকে মনে হয় লুবিনির-বর্ণিত ‘তরক’-এর মতো। রক্তাক্ত বৃহৎ যাযাবরী ‘তরক’ যেন পরিচিত সূর্য নয়। এবং সেই তরকের ভেতর থেকে যেন নেমে আসে একটি হেলো, মহিষ নয়। গলা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে সেই হেলো ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে, পিছনে সূর্য। ক্রমে স্পষ্ট হয়। হেলোর পিঠের উপরে একজন মানুষ আড়াআড়ি বসে আরেকজন মানুষ পাশে পাশে আসে।
আকালু ও শারিবা আগন্তুকদের দেখতে থাকে। নদীর পাড়ে এসে তারা থামে, তারপর নদী পার হয়। এপারে এলে শারিবা পরিষ্কার চিনতে পারে রূপাকে। যদিও লাল জমকালো লুঙ্গি তার পরনে, গায়ে নীল শার্ট, মাথায় হলুদ রঙের রুমাল কপালের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে টেনে বাঁধা। তবুও বাপকে চিনতে ভুল হয় না শারিবার। মোষের পিঠের উপর বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের তীক্ষ্ণ চেহারার এক যুবতী। তার দুই পাশে দড়ির শিকলিতে ঝুলিয়ে রাখা তিন তিন ছ-টা সাপের ঝাঁপি।
রূপা প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে তারপর নিঃসংশয় হয়, তারপর আবেগ ও গর্ব তাকে আপ্লুত করে।
শারিবা! হামার বেটা!
শারিবা নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে।
রূপা তার মুখে গায়ে হাত বুলায়, তার হাত কাঁপে, মুখের পেশী কাপে। সে আবার বলে, শারিবা? হামার বেটা।
শারিবা দাঁড়িয়ে থাকে।
রূপা তাকে ছেড়ে তার সঙ্গিনীর কাছে যায় দ্রুত। তার হাত ধরে টেনে নামায় তাকে।
শারিবা, হামার বেটা।
তার সঙ্গিনী দু-হাত উপরে তুলে ক্লান্তি ভাঙে শরীরকে মুচড়ে। ক্লান্ত অথচ কলহাস্য করে, বিস্ময় তার কণ্ঠে।
বাব্বা! এংকা জুয়ান বেটা তুমার!
রূপা আবার শারিবার কাছে আসে, কিছুটা বিল, কিছুটা সলজ্জ। সে সঙ্গিনীর পরিচয় দেয়।
শারিবা, ইয়া-ই-হইল শরমী।
সবার অলক্ষে আকালু গ্রামে ছুটে গিয়েছিল।
খুনী রূপা, পলাতক রূপা ফিরে আসে রঙ্গিলা রূপা হয়ে। এই হল যাযাবরী সভাব। আচমকা কথায় কথায় ছুরি ঝলসে উঠতে পারে, পরক্ষণেই আবার হয়ত হো হো হাসি, পানপাত্র হাতে। দাম্ভিক, হামবড়াই যাযাবর। আসল সাহসিকতার কাজে, ধৈর্যের কাজে, কষ্টসহিষ্ণুতার কাজে সে নেই।
জামির চেয়েছিল সেখান থেকে তাকে তুলে আনতে। শক্ত মাটির পৃথিবীতে তাকে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। সে বলত, যাও সব, যার যার ঘরের ছামুতে গাছ লাগাও। নদীর চড়ায় বাস, বালির রাজ্যি। আকাশের এক তরক জমিনে হাজার তরক জ্বালায়। গাছ লাগাও, হেঁয়া হবে। গাছ লাগাও খড়ি হোবে, গাছ লাগাও তক্তা হবে।