কাজেই দনুর সংসারে সালমা মানুষ হয়। কালক্রমে যৌবনবতী হয় এবং কোনো এক সময়ে তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট পীতেমের উপরে দুর্বার আকর্ষণ বোধ করতে থাকে।
এর আগেই অবশ্য পীতেমের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সালমার তখনো বিয়ে হয়নি। কারণ সালমা তখনো মনস্থির করতে পারেনি। বাজিকরের দলে এবং দলের বাইরেও তার পাণিপ্রার্থীর সংখ্য ছিল ভারি। ফলে সালমা হয়েছিল দাম্ভিক। এই ধরনের সুন্দরীদের স্তুতি করার জন্য অনেক মানুষ থাকে বলে অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়।
যেমন সালমার। তার সারাজীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়াই হল না।
শেষে ক্রমশ তার প্রেমিকরা হতাশ হতে হতে সংখ্যায় কমতে লাগল। সালমার দম্ভ তাকে সময় থাকতে এ-ব্যাপারে সতর্ক করেনি। তারপরে একসময় সে নিজেকে দেখেছিল নিঃসঙ্গ।
সেই সময়ই পীতেমের বিয়ে হয়, পীতেম তার স্ত্রীকে নিয়ে সালমার চোখের সামনে সারাক্ষণ মশগুল থাকে। সেই পীতেম, যার সঙ্গে সালমা একসঙ্গে বড় হয়েছে এবং চিরকাল জ্যেষ্ঠা হিসাবে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে, সেই পীতেম। এখন দু-জনে সম্পূর্ণ আলাদা জগতের হয়ে গেছে সালমার একাকিত্বকে আরো ভারি করে।
প্রথমত সালমার একটা অস্বস্তি ছিল, পরে সেই অস্বস্তি ঈর্ষায় পরিণত হয় এবং কখন নিজের অজান্তেই পীতেমের স্ত্রীকে সে প্রতিদ্বন্দ্বী করে ফেলে। শুরু হয় এক বিচিত্র অধ্যায় যা বাজিকরদের মধ্যেই সম্ভব।
পীতেমের স্ত্রী ছিল নরম চেহারার মানুষ, হয়ত যাযাবরী জীবনের উপযুক্ত নয়। ধন্দু জন্মাবার পরই তার শরীর ভাঙতে শুরু করে, পেমার জন্মের পর সে দীর্ঘদিন রোগভোগ করে, তারপর পরতাপ যখন তার পেটে তখনই ধরা পড়ে তার ক্ষয়রোগ।
এর উপরে ছিল সালমার কর্তৃত্বের যন্ত্রণা, যা সালমাকে তৃপ্তি দিত, পীতেমকে আহত করত এবং ধন্দুর মাকে জীবন সম্বন্ধে হতাশ করত। ক্রমশ রুগ্ন স্ত্রী যাযাবরের জীবনে অসহ্য হয়ে ওঠাতে পীতেম সালমার কাছে ধরা দেয়। যেহেতু তারা একসঙ্গে বড় হয়েছে তাই পরস্পরকে ভালো বুঝত। পীতেম সালমার কর্তৃত্বে শৈশব থেকে অভ্যস্ত, তাই এখন দলের সর্দার হয়েও সালমার কোনো কাজ কিংবা সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করে না। আর এখন দীর্ঘকালের অভ্যাসবশত প্রায় সব বিষয়েই সালমার পরামর্শও নেয় পীতেম।
ধন্দুর মায়ের মৃত্যুর পর তাদের সম্পর্ক যখন বিশেষ কারো কাছেই অপ্রকাশ্য থাকে না, তখন দলে কথা ওঠে। দল মূলত এ বিষয়ের নীতির দিকটাই বিচার করছিল। দনু আবার পীতেমকে বিয়ে করার কথা বলেছিল, পীতেম রাজি হয়নি। রাজি হয়নি এ জন্য নয় যে, সালমা তার কাছে অপরিহার্য ছিল। রাজি হয়নি, কারণ শালমার নিঃসঙ্গতা তাকে ব্যথিত করত।
আবার সালমা এবং পীতেম উভয়ের মধ্যে যখন বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠে তখন। দু-জনেই এ ব্যাপারে শিউরে উঠেছিল, কেননা দূ-জনের ধমনীতে একই রক্ত বইছে কিনা এ সম্পর্কে তারা নিঃসংশয় ছিল না।
কেননা, হাজার বছর আগে যখন তারা কোনো এক বিশাল নদীর ধারে স্থায়ী বসবাস করত, সেই সময়কার পৌরাণিক স্মৃতি তাদের ভারাক্রান্ত করত। যখন তাদের কোনো প্রাচীন পুরুষ পুরা এক নর্তকীর প্রতি আসক্ত হয় এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর শুরু হয় সেই অন্তর্কলহ, যা তাদের স্থায়ী বসবাসকে ছিন্নভিন্ন করে। মানুষ তখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পুরার বিরুদ্ধবাদীরা দাবি তুলেছিল, এ বিয়ে হতে পারে না, কেননা পালি নামের সেই নর্তকী নাকি তার বোন। সুতরাং এ বিয়ে হবে অসামাজিক এবং অমঙ্গলময়।
পুরার সমর্থকরা বলেছিল, এ বিয়ে হবেই, কেননা পালি যে পুরার বোন এর কোনো প্রমাণ নেই।
তারপর পুরা ও পালির বিয়ে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবতার অভিশাপ নেমে আসে তাদের উপর। অন্তর্কলহে সমস্ত মানুষ নষ্ট হয়। পুরা ও পালি দেশ-দেশান্তরে পালিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তারা কোথাও আশ্রয় পায় না এবং দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় করে দেয়। তোমরা এক বৃক্ষের ফল দু-বার খেতে পারবে না, এক জলাশয়ের জল দু-বার পান করতে পারবে না, এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রি বাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক—এক মৃত্তিকায় দু-বার নৃত্য করা দূরে থাকুক, দু-বার পদপাত পর্যন্ত করতে পারবে না। এই ছিল দেবতার অভিশাপ।
সেই থেকে বাজিকর পথেপ্রান্তরে ঘুরছে। সেই থেকে সে দেবতা থেকে বঞ্চিত। গৃহস্থের গৃহের নিকট পর্যন্ত সে যায়, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না।
সুতরাং বাজিকর এক ভিন্ন জীবন, এক অস্থির চলমান জীবনকে আশ্রয় করে আছে। সে নিজেকে ভুলিয়েছে নাচ গান এবং চিন্তাহীন সরল জীবনযাত্রায়। সে শিখেছে মানুষকে ঠকাতে এবং তা নিয়েই তার অহংকার। সে গ্রহণ করেছে বিচিত্র ভিক্ষাবৃত্তি, যার জন্য কোনো সংকোচ তার নেই।
তবুও প্রাচীন কিছু স্মৃতি কিংবা পাপবোধ কিংবা নিতান্তই বিশ্বাস তাকে এখনো চালিত করে, এখনো নিযুক্ত রাখে কিছু আস্তিক চিন্তায়। কিছু ভীতি অথবা দারুণ দুর্দিনের আশংকা তাদের সমস্ত বিধিহীন জীবনযাত্রাকেও বেঁধে রাখে নিয়মের নিগড়ে।
কিন্তু এই নিয়মের নিগড় থেকে বেগবান অন্য কিছু তাদের একজনকে অন্যের সঙ্গে যুক্ত রাখত। পীতেম কিংবা সালমা কেউ জানবে না তাদের পরবর্তী তৃতীয় এবং চতুর্থ পুরুষেই বিষয়টি নিয়মে পরিণত হবে বাধ্য হয়ে, যে বাধকতায় পুরা ও পালি আনীত অভিশাপ মূল্যহীন হয়ে যাবে।