দয়ারাম কথাটা গায়ে না মেখে রঙ্গচ্ছলে নেয়। বলে, সাবাস বলেছ, ভান্মতি। অস্বীকার করি না, আক্ষেপ কিছু আছে বটে দয়ারামের। জড়িবুটি, গুণ-তুকে তোমার নামও শুনেছি। দরকার আমার তোমার সঙ্গেও। আরো বলি, ভান্মতি, তুলনাটা তোমার লাগসই হল না।
তারপর মোষের দাম নিয়ে একটা ক্লান্তিকর টানাটানি করে শেষপর্যন্ত উভয়ে (পৌনে ৭শ টাকায় রাজি হয়।
ততক্ষণে সালমা উঠে চলে গেছে। দয়ারাম তার ছাউনি খুঁজে বার করে নেয়। সালমা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। অথচ সে ভাব মুখে প্রকাশ করে না।
দয়ারাম বলে, ভাতি, তোমার গুণের কথা শুনেছি দু-চারজনের কাছে, তার মধ্যে জানকীরাম দারোগাও আছে। দারোগা আমার বন্ধুলোক।
তবে তো তোমাকে খাতির করতেই হয়, মালিক। সালমা বলে। সালমা এভাবেই কথা বলে। সব কথাতেই উদ্দিষ্ট একটা সরস তাচ্ছিল্য টের পেয়ে যায়।
বস্তুত, সালমা মানুষের অন্তরঙ্গ জীবন বড় বেশি দেখেছে, বিশেষ করে গৃহস্থ মানুষের। গৃহস্থ মানুষের যেসব বিচিত্র গোপনতা আছে, বাজিকরের মিল নেই তার সঙ্গে কিছুই। অথচ, সালমার কালো চোখের তারায় সামনে-বসা মানুষটির অনেক কিছুই ধরা পড়ে। সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে তার রহস্যময় মনের অন্ধকারে যেসব আকাঙ্ক্ষাগুলো নড়াচড়া করে।
দয়ারাম বলে, সময় যখন আছে, হাতটা তোমাকে দেখিয়ে যাই, ভান্মতি।
সালমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতটা টেনে নেয়। নরম চর্বিযুক্ত হাত। তিনটে পাথর বসানো আংটি আঙুলে। কব্জির হাড় নরম। বাহুতে বিশেষ কোনো শিরা দেখা যায় না।
সালমা আবার তার মুখের দিকে, চোখের দিকে এবং দেহের অন্যত্র দ্রুত দৃষ্টিপাত করে দেখে নেয়। গলায় তুলসীর মালা। দয়ারামের দেহে অধিক মেদ নেই। মুখে আবছা লেগে থাকা কর্কশ বিরক্তি, লোভ, দাপট এবং দম্ভ।
সালমা তার হাত ছেড়ে দিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইল। তীক্ষ অথচ অনির্দিষ্ট দৃষ্টি তার। তারপর দয়ারামের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, কি জানতে চাও মালিক?
সবই তো জানতে চাই, ভাতি, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান—
আগে টাকা দেও।
দয়ারাম হেসে কোমরের গেঁজে থেকে দুটি টাকা বের করে সালমার হাতে দেয়।
সালমা বলে, দু-টাকায় হবে না, আরো দু-টাকা বের করো।
দয়ারাম তাই করে।
সালমা বলে, শোনো মালিক, দিন তোমার ভালো যাচ্ছে এখন, পয়সাও আসছে প্রচুর। কিন্তু মন ঠিক নেই, কারণ, শরীর আর কথা শুনছে না। একটি আদরের জিনিস অথবা জনকে হারিয়েছ সদ্য,শোক ভুলতে পারছ না। আবার কিছু করারও নেই, মেনে নিতে হচ্ছে। কি তাই নয়?
দয়ারাম সালমার হাত চেপে ধরে।
ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ তুমি, ভান্মতি।
সালমা হাত ছাড়িয়ে নেয়।
অন্যদিকে তাকিয়ে আবার বলে, দু-বছরের মধ্যে তোমার আরো দুর্দিন আসছে। তোমার এই ধনসম্পত্তি আর কোনো কাজে নাও লাগতে পারে।
দয়ারামের নাকের পাশে ঘাম জমে। আঁতকে উঠে সে বলে, কেন? কেন, ভাতি?
তা আমি বলতে পারব না। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার সুদিন স্থায়ী হবার নয়।
দুর্দিন কি করে কাটবে?
সালমা চোখ বুজে বসে থাকে।
তার পর বলে, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
দয়ারাম অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে খাটিয়ায়। প্রকাশ্যেই ভয়ানক ঘাবড়ে গেছে সে। আঁতিপাঁতি করে নিজের অভ্যন্তরে এবং পারিপার্শ্বিকে খুঁজে কোনোরকম অদৃশ্য শত্রুকে আবিষ্কার করতে পারে না। কোম্পানির আমলে বাঘ-বকরি একত্রে জল খায়, আর সে-কোম্পানির থানা, পুলিশ, সাহেব হাকিম, সবই তার হাতে। সাহেবি আইনের বাইরে সে কিছু করেও না। তবে?
ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে তার। সে ভাবে বাজিকর রমণীর এ এক রকমের বুজরুকি। সে বলে, ভান্মতি, সে যা হবার তা হবে। এখন কিছু দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা কর। জানকীরাম দারোগা তোমার দাওয়াইয়ের কথা আমাকে বলেছে।
সালমা উঠে যেতে যেতে বলে, দাওয়াই বানাতে হবে। দু’দিন বাদে লোক পাঠিয়ে দিও দু’টাকা দিয়ে।
সালমা উঠে চলে যায়। দয়ারামও ওঠে। তার চাকর মোষের দড়ি হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার জন্য। একজন সাঁওতাল। অদ্ভুত শান্ত আর নিরীহ দেখতে মানুষটাকে। এতক্ষণে কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। লোকটা জোয়ান এবং বিষণ্ণ।
দয়ারাম গাছে বাঁধা ঘোড়ার কাছে গেলে সেই সাঁওতাল মোষের দড়ি ছেড়ে দিয়ে ঘোড়ার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে। দয়ারাম তার ঘাড়ের উপর পা দিয়ে ঘোড়ায় উঠে আড় হয়ে বসে। সে দু-দিকে পা ঝুলিয়ে বসতে পারে না।
দয়ারাম চলে গেলে সালমা পীতেমের কাছে আসে। পীতেম সালমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কিছু গোপনীয়তা আছে। ধন্দু, পেমা এবং পরতাপের মা যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিনই ব্যাপারটা সত্যিকার গোপনীয়তার পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সেই রুগ্ন স্ত্রীলোকটি পীতেমকে সময় থাকতেই রেহাই দিয়ে গিয়েছে। যক্ষ্মা রোগে অনেক অল্প বয়সেই সে মরেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সালমা-পীততমের সম্পর্ক স্বাভাবিকতার পর্যায়ে আসেনি। এর মধ্যেও কিছু অতীত কারণ বিদ্যমান।
কোন এক দূর অতীতে বাজিকর এবং বানজারা এই দুই যাযাবর গোষ্ঠী একই জায়গায় ছাউনি ফেলে। সেই সময়ে পীতেমের বাপ দনুর জোয়ান বয়স ছিল। দনু বানজারা যুবতীদের পাগল করেছিল। তারপর দুই দল যখন দু-দিকের রাস্তার ধরে, তখন দেখা গিয়েছিল বানজারাদের দলে এক যুবতী কম এবং বাজিকরের দলে এক যুবতী বেশি।
সেই যুবতী সালমার মা। দনুর নিজস্ব স্ত্রী-সন্তানাদি থাকতেও অতিরিক্ত হিসাবে সেও ছিল। সালমা তার প্রথম সন্তান। এ সন্তানের পিতৃত্বের দাবিদার কে, এ সম্পর্কে সালমার মায়েরই সংশয় ছিল। পরবর্তীকালে সেই যুবতী আরো দু-বার গর্ভবতী হয় দনুর সহায়তায়। প্রথমবারে সে মৃত সন্তান প্রসব করে আর দ্বিতীয়বারে সন্তানসহ নিজেই মারা যায়।