এই মানুষগুলো চকচকে কালো, উজ্জ্বল দাঁত তাদের, অফুরন্ত তাদের আনন্দ। পীতেম তাদের দেখেছিল বিস্ময়ের সঙ্গে। এরা বাদিয়া বাজিকরের মতো নয়, আবার এরা সাধারণ গৃহস্থের মতোও নয়। এরা পণ্ডিতও নয়, মূখও নয়। প্রকৃতির সছে একাত্ম, খেটে-খাওয়া মানুষ এরা। পাহাড় ভেঙে, জঙ্গল পরিষ্কার করে অবিশ্বাস নিষ্ঠায় তারা ফসলের জমি তৈরি করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা পরিশ্রম করে, তার পরেও গান গায় এবং নাচে, জীবনকে উপভোগ করে।
এই মানুষ হড়, এই মানুষ সাঁওতাল। পীতেম দেখেছিল রাজমহল, বারহেট, আমগাহিয়া, পিপড়া ইত্যাদি শহর-গ্রাম-হাটে এইসব মানুষ দ্রব্য বিক্রয় এবং বিনিময় যাই করুক না কেন, প্রায় সবসময়ই অর্তে প্রকারান্তর থাকে। যখন বেচে জন শতি থাকে একরকম, যার নাম ‘হাচ্কা’, অর্থাৎ ঝুড়িশুদ্ধ অথবা গাড়িশুদ্ধ, কখনোই ওজনের নয়। আর যখন ক্রয় করে, তখন গোলাদার, মহাজন অথবা যে-কোনো ক্রেতাই হোক না কেন, পদ্ধতিটা হয় ওজনের। সে সময় যে বাটখারা ব্যবহার করা হয় তার কোনো নির্দিষ্ট ওজন-মান নেই, নেই কোনো সাধারণ সর্বজনীতাও। যে যেমনভাবে পারে এই জটিলতাবর্জিত হড়কে বুঝ দিচ্ছে, তা ওজনে হোক কিংবা পয়সায় হোক। আর কী আশ্চর্য, এরা বুঝে যাচ্ছে, মেনে নিচ্ছে, খুব যে অখুশি তাও মনে হচ্ছে না।
সুতরাং পীতেম মনোযোগ দেয় কিছু সঞ্চয়ের দিকে। তার বহুদেশদর্শী ইন্দ্রিয় বলছিল, এ অবস্থা বেশিদিন চলবে না। কাজেই যতদিন চলে, যতদিন বাজার গরম থাকে, তার মধ্যেই তারা যাযাবরী ব্যবসায় অর্থোপার্জন করতে থাকে।
সে পরতাপ এবং জিল্লু এই দুই বাজিকরকে ঘোড়ায় করে মুর্শিদাবাদে পাঠায় সওদা আনতে। রূপা, তামা, পেতল, রাঙ এবং গালার নানান ধরনের গহনা এবং অন্যান্য মনোহারী জিনিসের চলন খুবই বেশি। এসবের বিনিময়ে পাওয়া যায় খাদ্যশস্য এবং তৈলবীজ। যা আবার গোলদার কিংবা যে-কোনো ব্যবসায়ীর কাছে নগদ টাকায় বেচা যায়। দাম ইদানীং খুবই ভালো। বিশ সের গম, পনেরো সের চাল অথবা দশ সের তৈলবীজের বদলে এক থেকে দেড় টাকা পাওয়া যায়। আর এইসব চাল, গম কিংবা তৈলবীজ চতুর মানুষের পক্ষে সংগ্রহ করা মোটেই কঠিন।
পীতেম বলে, উঁইসের বাচ্চাগুলোকে ভালো করে ঘাসজল দেও তোমরা। ওগুলোকে এবার হাটে তুলতে হবে।
বস্তুত পাঁচটি গাবতান ভঁহী পাঁচটি নধর শাবক দিয়েছিল। সেইসব শাবকেরা যথাসময়ে আবার বংশবৃদ্ধি করেছিল। বাজিকরেরা নিজেরাই এঁড়েগুলোকে খাসি করত। কেননা, বলদ-উঁইসের বাজার সব দেশে এবং সবসময়ই ভালো। এখন বাজিকরের তাঁবুতে অনেকগুলো বলদ-ইস আছে, যারা উঠতি জোয়ান। এক বছর শিক্ষিত মোষ কিংবা বলদের পিছন পিছন নবিশি করলে পরের বছর স্বাধীনভাবে কাজ করানো যাবে।
বাজিকরের ছাউনিতে জানোয়ার কিনতে মানুষ হামেশাই আসে। দয়ারাম ভকত নামে এক মহাজন মোষ কিনতে এসে পীতেমের সঙ্গে আলাপ জমায়। বাজিকরের হালচাল, ব্যবসাবাণিজ্য এবং ওষুধপত্তরের খোঁজ নেয়। প্রচুর সম্পত্তির মালিক দয়ারামের দেহে সুখ নেই। পীতেম জানে, দয়ারামের যা বয়েস তাতে দেহে নতুন করে সুখ আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ঝানু মহাজন সমস্ত কিছু বুঝেও এ জিনিসটা বুঝতে পারবে না, এও পীতেম জানে। আর বুঝলে পরে বাজিকরেরই বা চলে কিসে?
কিন্তু দয়ারাম ব্যবসাদার, কাজেই মোষ কেনার ব্যাপারটাই সে প্রথমে উত্থাপন করে। গুহ্য ব্যাপার, যার সঙ্গে দুর্বলতা জড়িত, তা পরে প্রসঙ্গ হিসাবে রেখে দেয়। আবার পীতেমও জাত বাদিয়া। সেও জানে, এরপরে দয়ারামের কাছ থেকে কী প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবে আসতে পারে। সে সালমাকে কাছাকাছি রাখে। সালমা প্রৌঢ়া, কিন্তু তার শরীর কোনো অজ্ঞাত কারণে টনটান এবং স্তনদ্বয় এখনো উদ্ধত।
দয়ারাম বলে, বাজিকর, তোমার এ দাফার উইসের দাম আশি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
পীতেম বলে, মহাজন আদমি আপনি, জানোয়ারের দাম আপনার থেকে ভালো জানবে কে? তবে কিনা মুঙ্গেরি ভঁইস, পুরা জোয়ান হলে একটা হাতির কাজ করবে।
মুঙ্গের? মুঙ্গেরে কি ভালো ভঁইস হয়! আমার জানা নেই, বাজিকর। তোমার দামটা শুনি।
মালিক, ঠিকঠাক যদি বলতে দেন, তো বলি, তিনশ’ টাকা এর দাম হয়।
বেচার দাম বল, বাজিকর। দয়ারাম ভকতকে এ তল্লাটে সবাই চেনে। জানোয়ার কিনব বলেই তোমার কাছে আসা। আর দশটা বাজে লোকের মতো তোমার ছাউনির আওরত দেখতে ছল করে আসিনি।
সুযোগ পেয়ে পীতেম একটু গম্ভীর হয়। বলে, মালিক, বাজিকরের আওরত হাটেবাজারে ঘুরে বেড়ায়, খেলা দেখায়, হাজার দ্রব্যের বেসাতি করে। তাকে দেখার জন্য ছাউনিতে আসতে হয় না। কিশনজির নাম নিয়ে বলেন যে দাম বললেন, তা নিয়ে আজকাল একটা ধাড়ি শুয়োরও কেনা যাবে কিনা?
আরে রাম, রাম! সকালবেলাটা ওই জানোয়ারের নাম নিয়ে দিনটা মাটি করলে আমার? ও জিনিস কখনো কিনিনি, তাই তার দামও জানি না। তবে এ কথা জানি বাজিকর, ও দাম দিয়ে একটা মানুষ কেনা যায়।
হাঁ, জংলি আদমি একটা কিনতে পারেন বটে, কিন্তু মুঙ্গেরি ভঁইস হবে না।
তবেই দেখো, একটা আদমির থেকে একটা ভঁইসের দাম তুমি বেশি বলছ, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
সুযোগ বুঝে সালমা আসল জায়গায় ঘা মারে দয়ারামের। বলে, আদমির থেকে জানোয়ারের দাম সব সময়ই বেশি থাকে, জনমভর এমনই তো দেখে আসছি, ভকতজি। যেমন ধর, রাতের বেলা কোনো আওরতের কাছে তোমার দাম কী হবে?