এদের আসতে দেখে ধন্দু উঠে দাঁড়ায়। কোনো কথা না বলে নিজের ঘোড়ায় উঠে তাঁবুর দিকে চলতে শুরু করে। এরা চারজন নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে।
কিছু সময় পরে পীতেম বলে, তোর নানা বলত, মাঠে যত জানোয়ার চরে তার সবই বাজিকরের।
আর ধন্দুও প্রায় বালির কথাটাই বলে। বলে, কিন্তু এটা দারোগার।
কিন্তু দারোগার মান তো রাখতেই হবে।
আজ রাতেই তো এখান থেকে চলে গেলে হয়।
পাগল!
তাহলে দারোগাকে তোমার অনেককিছু দিতে হবে, শুধু ঘোড়ায় হবে না।
পীতেম বলেছিল, এ দেশে পয়সা আছে। ভিখ-মাঙ্গা বাজিকরের কাছ থেকে আর কি নেবে দারোগা!
পরদিন দারোগার ছেলে এসে হাজির হয়েছিল সকাল-সকালই। বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা। পীতেম বলেছিল, আসুন, ছোট হুজুর, বসুন।
ছোকরা বলে, বসতে আসিনি। কোথায়, আমার ঘোড়া কোথায়?
বালি ঘোড়াটার লাগাম ধরে কাছে নিয়ে আসে। ধন্দু সেই একই গাছের নিচে তির্যকভাবে দাঁড়িয়ে।
পীতেম বলে, ছোট হুজুর, ঘোড়াটা বড় বজ্জাত, ভয় হয়, আঘাত না করে। দারোগার ছেলে বলে, আমিও বজ্জাত। দেখা যাক কে বেশি বজ্জাত।
সে অত্যন্ত অভিজ্ঞ দাম্ভিক ভঙ্গিতে হাসে, যা দেখে পাতেম অবাক হয়।
ছোকরা লাগামটা হাতে নিয়ে হাতের চাবুকে হাওয়ায় আওয়াজ তোলে। ঘোড়াটা চমকে ওঠে। সব তাঁবু থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে দারোগার ছেলেকে দেখতে। ছোকরা হঠাৎ লাফ দিয়ে নাঙ্গা পিঠে সওয়ার হয়।
ঘোড়াটা অবশ্যই বজ্জাত। ভীষণ ডাক ছেড়ে সে পিছনের পা জোড়া শূন্যে ছুঁড়তে থাকে। পরিষ্কার সওয়ারকে ফেলে দেওয়ার বাসনা। কিন্তু সওয়ার সহজে পড়ে না। দক্ষতায় সে আঁকড়ে থাকে ঘোড়ার পিঠ এবং শূন্যে চাবুকের শিস তোলে। জানোয়ারটা পরিত্রাহি চেঁচায় এবং এমনভাবে পিছনের পা ঘেঁড়ে যেন মনে হয় পায়ে তার সাপ জড়িয়েছে।
দারোগার ছেলে এবার ঘোড়াকে আঘাত করে। তাতে জানোয়ারটা আরো ক্ষিপ্ত হয়। যুবকের চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে উত্তেজনায়। সে আবার লাফ দিয়ে নামে ঘোড়া থেকে। লাগাম তার হাতেই থাকে। ধন্দু শব্দ করে হাসে। পীতেম কিছু বলতে যায়। যুবক লাগামে বারবার ঝটকা মেরে ঘোড়াটাকে আহত করার চেষ্টা করে, তারপর উন্মাদের মতো চাবুক চালাতে থাকে।
ঘোড়া প্রথমে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু দারোগার ছেলে গায়ে শক্তি রাখে। সে নিমর্মভাবে চাবুক চালায়। ঘোড়া এবার সামনের দু-পা তুলে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। ধন্দু চিৎকার করে ওঠে। বালি এবং আর একজন যুবক ধন্দুকে দুদিকে ধরে টেনে হিঁচড়ে তাঁবুর পিছন দিকে নিয়ে যায়।
সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে দিয়ে যুবক তার চাবুক থামায়। ঘোড়াটা সতর্ক স্থির হয়ে থাকে। তার সমস্ত শরীর থির থির করে। তার চোখ বিস্ফারিত। পীতেম নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকে।
যুবকটি আচমকা আবার লাফ দিয়ে ঘোড়ায় ওঠে। জানোয়ারটা এবার আর লাফায় না। শুধু পিছনের পা দুটো একটু নিচু করে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে।
যুবক পা দিয়ে তলপেটে তো মারে। ঘোড়া চলতে শুরু করে। লাগাম টেনে দারোগার ছেলে ঘোড়ার মুখ ঘোরায়। তারপর পীতেমের দিকে তাকিয়ে হাত তোলে। বলে, চলি সর্দার।
ঘোড়া অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাস্তায় উঠে যায়।
০৪.
রাজমহল, বারহেট, তিনপাহাড়, সাহেবগঞ্জের হাটেবাজারে পীতেমের দল রঙিন কামিজ আর ঘাঘরা উড়িয়ে নতুন বিহ্বলতা আনে। মোষের শিঙে বাঁধা দড়ি দুপাশে বাঁশ দিয়ে ঠেলে টনটনা করা হয়। তার উপরে লম্বা বাঁশ হাতে যে রমণী চলে ফিরে আগুপিছু করে তার শরীর বড় টান টান, তার চোখমুখে আগুনে মসৃণতা, তার গায়ের চামড়া পাকা গমের রঙের। নিচের যে মানুষটা ঢোলক বাজায় তার মাথায় রঙিন ফেট্টি। আর একজন উপরআলির চলার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে বিচিত্র গান গায়, যে ভাষা কেউ বোঝে না, কিন্তু সুরের মাদকতা এড়াতে পারে না।
মাধোয়া ধাইর্ যারে
মাধোয়া ধাইর্ যারে
ছোটি ঘোটানি মাধোয়া ধাইর যা
তিলেক্ পঢ়োরে তিলে পঢ়োরে
ছোটি ছোটানি মাসোয় ধাইর যা
হেরছি ফকড়িয়ে হেরছি ফকড়িরে
ছোটি ছোটানি হেরছি ফক্ড়ি।
নতুন নতুন বসতি সব, নতুন নতুন মানুষ, উঠতি বড়লোক, জাঁকজমক, ঠাট, সবই নতুন। বাজিকর ভাবে, হ্যাঁ, এমন জায়গাই বাজিকরের উপযুক্ত বটে। সাহেব, পুলিশ, মুন্সি, মহাজন, শুড়ি, কয়াল, দোকানদার, মোদক, দালাল সব মিলে একটা ব্যাপক লুঠের বন্দোবস্ত। প্রথমে বোঝা যায় না কে লুঠ করে আর কে লুঠ হয়। এ ভারি মজার ব্যাপার। যে লুঠ করে তার উল্লাস বোঝা যায়। কিন্তু যে মানুষটা লুঠ হচ্ছে সে কেমন করে দিনের শেষে শুড়ির দোকানে হুল্লোড় করে? মোরগা-লড়াইয়ে বাজি রাখে হাটে আনা শেষ সম্বল?
পীতেম বলে, বাজিকরের বেটারা, চোখ কান খোলা রেখে চল। দেখেবুঝে চল। পয়সা তোমাদের হাতে আসবে। দুঃখ তোমাদের ঘুঁচবে।
হাটের মাঝখানে বাজিকর খেলোয়াড়ের খেলার আসর যখন জমে ওঠে তখন পীতেম তার কিছু লোককে ছড়িয়ে দেয় হাটের মধ্যে। তারা নানারকম মনোহারি জিনিস বিক্রি করে অবিশ্বাস্য বিনিময়-মাধ্যমে। একটা রঙিন পুঁতির মালার বদলে একঝুড়ি চাল পাওয়া যায়, একখানা গালার চিরুনিতে পাওয়া যায় পাঁচ সের সরষে, নেশার জিনিষের বদলে সর্বস্ব দিতেও মানুষ রাজি থাকে।
এসব দেয় কারা? এসব দেয় যারা দুর দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে অথবা পিঠের বাঁকে শস্য নিয়ে আসে। যাদের কাখে গোঁজা একটি বাঁশি অবশ্যই হাত খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকে, যখন সে সমস্ত গ্লানি এবং শ্রমকে ভুলে সেই বাঁশিতে ফুঁ দেয়।