তারপর ঘটনা যত এগোতে থাকে নানারকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। বহেরা গ্রামের রণকৌশলগত অবস্থান ইংরেজদের অনুকূলে ছিল। এই গ্রাম থেকে সন্নিহিত অনেকগুলো গিরিসংকট ও বিস্তীর্ণ জলের উপর আধিপত্য সহজতর। ফলে ইংরেজ বাহিনী আচমকা আঘাত করে গ্রামটির দখল নেয় ও ঘাঁটি স্থাপন করে।
বহেরার লক্ষ্মণ সোরেনের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। শোনা যায় যে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মহেশপুর থানায় তাকে হত্যা করা হয়। বহেরা যখন ইংরেজদের দখলে আসে তখন সেখানে প্রতিরোধ করার মতো বিশেষ কেউ ছিল না। শিশু বৃদ্ধ ও মেয়েরা সেই গ্রামে অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছিল। ইংরেজরা যেসব গ্রাম দখল করেছে, সেখানে নির্বিচারে হত্যা এবং ধর্ষণ চালিয়েছে। কিন্তু বহেরার সৌভাগ্য, সেখানে পিয়ারসন নামে একজন ম্যাজিস্ট্রেট সেনানায়ক হিসাবে আসে। পিয়ারসন তার বাহিনীর উচ্ছলতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়। ফলে বহেরাতে হত্যা ও ধর্ষণ একেবারেই হয়নি। বরং পিয়ারসন বৃদ্ধ ও রমণীদের অভয় দিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে না যেতে অনুরোধ করছিল। সুতরাং একটা চাপা ভীতি ছাড়া বহেরাতে সাঁওতালদের অন্য কোনোরকম অস্বস্তি ছিল না।
বহেরা দখল হয়েছে শুনে ডুমকো তিন হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহী নিয়ে ঝটিকা আক্রমণে পিয়ারসনের ঘাঁটি বিধ্বস্ত করে। পিয়ারসন বন্দী হয়। বন্দীদের নির্বিচারে হত্যা করা তখন দুই বাহিনীর কাছেই অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। ডুমকা তার সহকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করে পিয়ারসন সহ ধৃত পাঁচজন অফিসারকে পরদিন হত্যা করা হবে।
এ খবরে বহেরার সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। ডুমকার মা পীথা মুর্মু এবং আরো চার-পাঁচজন রমণী সেইদিনই ডুমকা ও তার সহকারীদের কাছে এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চায়।
ডুমকা বলে, এসব ব্যাপারে নেতাদের যা নির্দেশ আছে তার অন্যথা করা যাবে না।
কিন্তু পিয়ারসন সাহেব এখানে কোনো অত্যাচার করেনি। বরং তার যেসব বদমাইস সৈন্য সেরকম করার চেষ্টা করেছিল, সাহেব তাদের শাস্তি দিয়েছে।
তবুও কিছু করার নেই। অন্যান্য জায়গায় যেসব ঘটনা হয়েছে তার বদলা হিসাবে পিয়ারসনকে মরতে হবে।
পীথা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়। সে চিৎকার করে বলে, যতবড় বীরই হোস না কেন, মনে রাখিস, এখনো ধুতি-পাঞ্চি তুলে পানটির বাড়ি মারতে পারি, কেননা, আমরা মা।
নেতারা বিরক্ত হয়, ডুমকা সেখান থেকে উঠে অন্যত্র চলে যায়।
পীথা আহত ও অপমানিত বোধ করে। উপস্থিত সকলকে শুনিয়ে সে বলে, তোদের সর্বনাশ হবে। তোরা কোনো নিয়মকানুন মানছিস না! সাঁওতালদের রীতি-নীতি এমন নয়। আমি দেখতে চাই, আমাদের নিষেধ সত্ত্বেও এই ডুমকা সোরেন কিভাবে পিয়ার সাহেবকে খুন করে!
গ্রামের কাছে টিলার নিচে বধ্যভূমি স্থির হয়। পিয়ারসন সহ চারজন সাহেবকে সেখানে পিছনে হাত বেঁধে নিয়ে আসা হয়। পিয়ারসনের মুখ ভাবলেশশূন্য, অন্যরা কাদছিল, দয়া ভিক্ষা চাচ্ছিল।
পীথা ভাবতে পারেনি ডুমকা তার নির্দেশ অমান্য করবে। কিন্তু ডুমকা তার পিতৃহন্তাদের ক্ষমা করতে পারে না। যুদ্ধে এ-ধরনের দয়ারও কোনো দাম নেই।
আর পীথা ভাবছিল সে মানুষটা থাকলে এমন কখনোই হতে পারত না।
বহেরায় পিয়ারসন সহ চারজন সাহেবক হত্যা করা হয় কুড়াল দিয়ে মাথায় আঘাত করে। চারজন পাশাপাশি হাঁটু গেড়ে বসেছিল পাহাড়ের দিকে মুখ করে। ঘাতক পিছন থেকে সোজাসুজি কুড়াল দিয়ে মাথায় আঘাত করে।
মানুষ দেখছিল এই হত্যাদৃশ্য। যারা স্বজন হারিয়েছিল তারা প্রতিশোধের আনন্দে চিৎকার করছিল। উল্লাস অনেকক্ষণ ধরে গ্রামটাকে গমগম ধ্বনিতে পূর্ণ রেখেছিল। পীথা উচ্চস্বরে অভিশাপ দিচ্ছিল ডুমকা ও তার সহকারীদের।
অনেকক্ষণ ধরে পাহাড়ের উপর থেকে প্রহরীরা নাকাড়া বাজাচ্ছিল। শুনতে পায়নি কেউ সেই বিপদ-সংকেত। যখন সকলের খেয়াল হয় তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ইংরেজ বাহিনীর কামানের প্রথম গোলাটা এসে পড়ে বধ্যভূমির জমায়েতের উপর। ফাঁকা জায়গায় কামান ও বন্দুক নিয়ে আক্রমণ। সুতরাং ব্যাপক ও নির্বিচার হত্যা।
সাঁওতাল বাহিনী জঙ্গল ও পাহাড়ের আড়ালের জন্য প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। সঙ্গে গ্রামের অবশিষ্ট মানুষ। পিছনে পড়ে রইল পঞ্চাশ-ষাটজনের মৃত ও অধমৃত দেহ। তার মধ্যে ডুমকা সোরেন একজন।
সংগ্রামপুরের ঘাঁটিতে ডুমকা ছিল না। সংগ্রামপুরে সাঁওতালরা বিশাল বাহিনীর সমাবেশ করেছিল। সংগ্রামপুরে সর্বাধিনায়ক ছিল কানু মুর্মু এবং সিদু মুর্মু, চাঁদরাই ছিল দ্বিতীয় সারির নেতা।
পরতাপ, জিল্লু ইত্যাদি তখন গভীরভাবে যুদ্ধের প্রকৃতি এবং পরিণতি বুঝবার চেষ্টা করছে, এই মানুষগুলোকে আরো ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করছে।
কেননা অনেক ঘটনা ঘটছিল যা তাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। পীথা মুমুর মৃত্যু তার মধ্যে একটি। তাছাড়া সাঁওতাল বাহিনীতে তাদের থাকার প্রধান আকর্ষণ ডুমকা আর ছিল না। সেটা একটা চিন্তার বিষয়। এই মানুষগুলোকে যে তারা সম্পূর্ণ চেনে না, এ বোধ এতদিনে তাদের হয়েছিল।
ডুমকার মৃত্যুর পর বহেরার মানুষেরা পীথা ও অন্য তিনজন স্ত্রীলোককে ডাকিনী মনে করেছিল।
কাজেই গুনিনের বিচারে তারা স্থান সাব্যস্ত হয়। যাবতীয় দুর্ভাগ্যের জন্য উন্মত্ত মানুষ তাদেরই দায়ী করে এবং হাত-পা বেঁধে এ চার রমণীকে কুপিয়ে মারে।