বাপ!
পীতেম হে, পীতেম, পুবের দেশে যাও, বাপ। সিথায় তুমার নসিব।
পুবের দেশেত্?
পীতেম, হে পীতেম, রহু তুমার সহায় থাকুক।
পরদিন পীতেমের দল জঙ্গলের পথ ধরে দিগন্তের দিকে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে গেল পাঁচটি গাবতান মোষ, পাঁচটি বাছাই টার্টু। পথে সেই মোষদের নধর বাছুর হল। দুধের বান ডাকল। সেই দুধ-ঘি বাজিকরের মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করতে করতে চলল। সেইসব জানোয়ারের বংশ বাড়ল। বাজিকর তখন জানোয়ারও বেচত।
এইভাবে শারিবা, গোরখপুর থিকা, ডেহরিঘাট, সিথায় ক-বছর, তা-বাদে সিওয়ান, সিথায় ক-বছর, তা-বাদে দানাপুর, পাটনা, মুঙ্গের, কত দেশে তোর নানার নানা বসত করার চেষ্টা করল, হল না। তারপর এই পুবের দেশ। তা এখানেও কি স্বস্তি আছে? মানুষ চায়, বাউদিয়া বাউদিয়াই থাকুক, বাজিকর বাজিকরই থাকুক। তার আবার ঘর-গেরস্থালি কি? রাজমহল, মালদা, নমনকুড়ি, রাজশাহী, আমুনাড়া, পাঁচবিবি। সব শেষে এই পাঁচবিবি। আরো কত দ্যাশ ঘুরলো সি বাজিকরের দল, তোক আর কি কমো। সব কি কারো স্মরণ আছে?
বাউদিয়া-বাজিকর পিছনে যা ফেলে যায় তা জানোয়ারের বিষ্ঠা, কে তার কথা স্মরণ করে? যা পরিত্যাজ্য তাই পিছনে ফেলে যেতে হয়। তার কথা মনে রাখার কোনো কারণ নেই। তবুও পীতেম বৃদ্ধ বয়সে নাতবউ লুবিনির কাছে এসব কথা বলত। কেননা ধন্দু জোয়ান বয়সে খুন হয়েছিল। জামিরের বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে, তখন লুবিনির বয়স দশ বছর। সেই দশ বছরের মেয়েকে সামলানোর দায় ছিল পীতেমের। বাজিকরের তাঁবুতে এত কম বয়সে বিয়ের রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু এই পুবের দেশে সাহেবদের তখন বড় হাঁকডাক। কিভাবে যেন রটে গিয়েছিল, মহারানির রাজত্বে সোল বছরের ঊর্ধ্বে ছেলেমেয়েদের আর বিয়ে দেওয়া যাবে না। দিলে বে-আইনি হবে। এরকম গুজব হামেশাই রটত তখন। কেউ তলিয়ে ভাবত না, ভয় পেত। কাজেই একদিন পনেরো জোড়া বাজিকরের ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। তার মধ্যে জামির আর লুবিনিও ছিল।
তাই পীতেম সামলাত লুবিনিকে। পীতেম বলত শনিবারের ভূমিকম্পের কথা। পীতেম বলত ডেহরিঘাট, সিওয়ানের কথা। তারপর রাজমহলের কথা।
০৩.
রাজমহলের গঙ্গার ধারে বাজিকরের ছাউনি পড়ল সারি সারি। রাজমহল তখন গমগমা জায়গা। এখানে সেখানে রেলের লাইন বসছে। গঙ্গায় শয়ে শয়ে মহাজনি নৌকো। গোছগাছ হয়ে গেলে দলের লোকদের ডেকে পীতেম বলে, এ জায়গা মনে হচ্ছে পয়সার জায়গা। যে যার মতো কাজে লেগে পড়। বাপ আমাকে বলেছিল পূবের দেশে আসতে। এ হল সেই পুবের দেশ। গোরখপুরের ঠিকানা তো উঠেছে। নতুন ঠিকানা বানাতে হবে। এখন পয়সা কামাও।
কদিনের মধ্যেই খবর পেয়ে দারোগা এসে হাজির হয়। পীতেম বলে, চৌকিদার দিয়ে খবর পাঠালেই হতো, হুজুর। কষ্ট করলেন।
দারোগা প্রতি ছাউনিতে উঁকি দিয়ে দেখল। তারপর বলে, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
পীতেম মিথ্যা কথা বলে, কেননা, এরকমই নিয়ম।
দারোগা বলে, কতদিন থাকা হবে?
পীতমের অনির্দিষ্ট উত্তর, কেননা, এরকমই নিয়ম।
দারোগা তারপর জন্তু জানোয়ার দেখে এবং সবচেয়ে দামাল ঘোড়াটি পছন্দ করে।
পীতেম একটু বিপদে পড়ে, কারণ ঘোড়াটা ধন্দুর বড় আদরের এবং ধন্দুকেই সে সওয়ার হিসাবে সহ্য করে। সে বলে, হুজুর, ও বজ্জাতকে নিয়ে পোষাতে পারবেন না। ও হুকুম মানে না, পোষ মানে না। নিয়ে গেলেও পালিয়ে আসবে।
দারোগা এসব অজুহাত মনে করে। তাছাড়া ঘোড়াটা তার পছন্দ হয়েছে এবং ছেলের জন্য একটা তার দরকারও।
দারোগা বলে, দেখ, বাজিকর, জানোয়ারটা আমার চাই। পরে পাঠিয়ে দিও।
পীতেম তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে নানাভাবে। বলে, হুজুর, ও জানোয়ার অবাধ্য। আপনি আর চারটার মধ্যে যেটা হয় একটা বেছে নিন। না হলে পরে আমায় দোষী করবেন।
পীতেম এসব কথা বলছিল, এবং ধন্দুর দিকে নজর রাখছিল। ধন্দু গম্ভীর মুখে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
দারোগা কথা না বাড়িয়ে লাফ দিয়ে নিজের ঘোড়ায় উঠে টাপটাপ শব্দে সামনে এগোয়। সঙ্গের চৌকিদার বলে, বাজিকর, ঘোড়া কাল সকালের মধ্যে পৌঁছায় যেন, না হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।
ধন্দু হঠাৎ লাফ দিয়ে তার আদরের ঘোড়ায় উঠে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সে গঙ্গার বালিয়াড়িতে নেমে পড়ে সামনের দিকে ঘোড়া হাঁকাতে থাকে পাগলের মতো। পীতেম শুধু তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। ধন্দু দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। গঙ্গার বালিয়াড়িতে ধুলো ওড়ে, তার মধ্যে ধন্দুর মাথার লাল ফেট্টির ঝলক দেখা যায় শুধু। কিন্তু পীতেম জানে ঘোড়াটা দিতে হবে।
অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরেও ধন্দু ঘোড়া নিয়ে ফিরল না। বাজিকরদের খোলা আকাশের নিচের রাত্রিবেলার আহার শেষ। সব তাঁবুর সামনের আগুনই প্রায় নিবে এসেছে, কিন্তু ধন্দু ফিরল না।
মাঝরাতে পীতেম আরো তিন জোয়ান বাজিকরকে ডেকে ওঠাল। ধন্দুকে খুঁজে বের করতে হবে, কাল সকালে ঘোড়াটা দারোগাকে দিয়ে আসতে হবে।
চারটি টাটুতে চারজন সওয়ার হয়ে গঙ্গার পলি ভাঙতে থাকে।
পীতেম বলে, আমার বাপ বলেছিল, দুনিয়ার সব মাঠে-চরা জানোয়ার তোমার।
বালি নামে এক যুবক বলে, কিন্তু তার মধ্যের ভালোটা দারোগার।
জ্যোৎস্নালোকিত বালির চড়ায় চারজুন ঘোড়সওয়ার হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠে স্তব্ধতা ভাঙে।
পীতেম বলে, ধন্দুটা বোকা। ভালো ঘোড়া মাঠে আরো চরবে।
চাঁদের আলোয় বাঁ পাশে রুপোর মতো চঞ্চকে গঙ্গা রেখে দু ক্রোশ মতো পলি ভাঙে তারা। তারপর ধন্দুকে পায়। গঙ্গার দিকে পিছন দিয়ে সে বসেছিল। সামনে ঘোড়াটা দাঁড়িয়েছিল ছবির মতো।