ফলে দারোগা আরো উত্তেজিত হয়। প্রতিপক্ষ যদি উত্মা দেখায় প্রহারের যৌক্তিকতা জোরদার হয়। সে লাথি মারে সালমার গায়ে। এত দুঃসাহস, দারোগার মুখের সামনে হাত নাড়ায়।
সালমা ছিটকে পড়ে। একজন সিপাই তার কেশাকর্ষণ করে। সালমা উন্মাদ হয়ে যায়। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে পীতেমকে। এই অসুস্থমস্তিষ্ক মানুষটাকে যদি অত্যাচার সহ্য করতে হয় পাগল হয়ে যাবে সে। তীক্ষ্ণ, অপরিচিত চিৎকার করে সে।
খবরদার দারোগা, সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে। সর্দারের গায়ে হাত দেবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমার।
এক থাবা ধুলো নিয়ে সালমা তাতে থুথু ছিটায় এবং বিড়বিড় করে। টানা-হেঁচড়াতে তার উড়নি খসে পড়েছে, চোলি ছিঁড়ে দৃশ্যমান তার দুই পীনস্তন। ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে। সিপাইরা ভয় পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু দারোগা এত সহজে ভয় পেল না। সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা তার। তার উপরে যথার্থই ক্ষিপ্ত সে। আর এইসব উত্তেজক নাটকে ক্ষিপ্ততা তার বেড়েছে আরো।
সে নিজে এবার উঠে এসে সালমাকে আঘাত করল। অনাবৃত স্ত্রীশরীরে আঘাত ছিল এই অনাবশ্যক ঝামেলাটাকে একটা,খুপরিতে আপাতত বন্ধ করে রাখা। সেই উদ্দেশ্যেই সে সালমাকে আঘাত করতে করতে পাশের একটা কুঠুরির দিকে আকর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু কুঠুরিতে ঢুকিয়েও সে তার হাতকে থামাতে পারে না। মারতেই থাকে।
সালমা শুধু তার মুখকে আঘাত থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছিল। তারপর যখন সে দেখে দারোগা তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করার প্রয়াস পাচ্ছে, সে আর বাধা দিল না। সে বুঝতে পারে, এবার জানকীরামের নেশা ধরে গেছে। পুরুষ চরিত্র সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা গভীর। সে এই ভেবে স্বস্তি পায় যে আপাতত এই ক্রুদ্ধ দানবীয় মানুষটাকে পীতেমের উপরে আঘাত করা থেকে নিরস্ত করতে পেরেছে।
সালমা এখন বুঝতে পারে, মানুষটা যতটা না পরিশ্রান্ত তার থেকে বেশি হাঁপাচ্ছে। মিশ্র উত্তেজনা তাকে ক্লান্ত করছে। ক্রমশ তার হাত শ্লথ হয়ে আসতে থাকে এবং একসময় থেমে যায়। ক্লান্ত, ক্রুদ্ধ, ঘর্মাক্ত জানকীরাম তখন আবিষ্কার করে তার সামনে এক অসামান্য রমণীশরীর, বয়স যাকে স্পর্শ করতে পারেনি, জীবনযাত্রার কঠোরতা যাকে কর্কশ করতে পারেনি। সে অসহায় বোধ করে নিজের অভ্যন্তরে এবং পা দিয়ে পিছনের দরজা ভেজিয়ে দেয়। সালমা আপত্তি করে না।
১৮.
আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র আশ্বিন, এই চার মাস সাঁওতাল বাহিনীর সঙ্গে পরতাপ, বালি, জিল্লু এবং পিয়ারবক্স এই চারজন বাজিকর যুবক পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগল। লোহার কাজে ছিল তাদের স্বাভাবিক দক্ষতা। সেই দক্ষতা এখন প্রয়োজনে লাগে। অস্থায়ী শিবির যেখানেই হয় প্রথমেই কামারের হাপর বসে সেখানে। তীরের ফলা, বল্লম, তরোয়াল ইত্যাদি লোহার অস্ত্র তৈরি হয় সেখানে। অস্ত্রের প্রয়োজন দিনদিন বাড়ছে। নিত্যনতুন সাঁওতাল দল গ্রাম ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।
পীরপৈঁতি পাহাড়ে অনেক চমক হয়েছিল। ইংরেজদের অতবড় বাহিনীর পরাজয় এবং পলায়ন, ডুমকার সঙ্গে বাজিকর যুবকদের মিলন, তাদের সাহায্যে চেতন মাঝির উদ্ধার—এসব ঘটনায় শিবিরে সেই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও প্রাণবন্ত উৎসব চলে।
তারপর যুদ্ধ আর যুদ্ধ। গ্রামের পর গ্রামে সাঁওতাল বাহিনী জমিদার, পুলিশ, মহাজন এবং ঘাটোয়ালদের কচুকাটা করে ‘ফারকাটি’ অর্থাৎ সর্বস্ব শোধ দিল। মুক্ত হল তাদের সব ঋণ থেকে। শোষণে ও অত্যাচারে তারা নির্মম হয়েছিল। কোথাও কোথাও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও তারা রেহাই দেয়নি। নারায়ণপুরের জমিদারকে তারা হত্যা করেছিল নৃশংসভাবে।
সাঁওতাল পরগণা, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাঁওতাল বিদ্রোহীদের দখলে এল। তারপর দানাপুরের সামরিক ঘাঁটি থেকে সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে ইংরেজরা সাঁওতাল গ্রামগুলোর উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর যা শুরু হল তা যুদ্ধ নয়, নিতান্তই গণহত্যা। পাহাড়ে ও জঙ্গলে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে সাঁওতালরা অসহায়ের মতো মরছিল। মাথার উপরে ছিল না কোনো আচ্ছাদন, কিছু না খাদ্যের কোনো জোগান।
আশ্বিন মাসে সংগ্রামপুরের কাছে পাহাড়ে সাঁওতালরা শিবির স্থাপন করল। একটা মরিয়া ভাব সবার মধ্যেই তখন তীব্র হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহের নেতারা দিনেরাতে আলোচনায় বসছে, সভা করছে, সৈন্যদের মনোবল বাড়াচ্ছে। বন্দুককামানের বিরুদ্ধে তিরধনুক, বল্লম, তরোয়ালের যুদ্ধ। কাজেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও অসাধারণ মানসিক শক্তি ছাড়া এরকম যুদ্ধের মোকাবিলা করা সাঁওতালদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
পরতাপ, বালি ইত্যাদি বাজিকরেরা ইতিমধ্যেই যুদ্ধের পরিণতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে। বস্তুত, যে কারণে তারা পীরপৈতির ইংরেজ ঘাঁটি ত্যাগ করে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তার মধ্যে মহত্তর কিছু সেই মুহূর্তে ছিল না। ডুমকা সোরেনের পরিবার ও অন্য সাঁওতালদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার ফলে একটা আকর্ষণ তাদের জন্মেছিল। কিন্তু সাঁওতালরা যে শোষণে নিপীড়িত, সে ধরনের শোষণের সঙ্গে বাজিকরেরা অভ্যস্ত নয়। কাজেই এ ব্যাপারে কিছুটা সহানুভূতি ছাড়া তাদের ভিতরে অন্য কিছু ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, চতুর বাজিকরেরা সবসময়ই তাৎক্ষণিক লাভালাভকেই বেশি মূল্য দিতে অভ্যস্ত। পীরপৈতির ইংরেজদের আধুনিক রণসজ্জা ও আগ্নেয়াস্ত্র দেখেও তাদের মনে হয়েছিল যে ইংরেজরা হারবে। এর সমর্থনে তারা ইংরেজ বাহিনীর মনোবল ও সাঁওতালদের তুলনায় তাদের সৈন্যসংখ্যার অপ্রতুলতার কথাই হিসাবের মধ্যে এনেছিল। এর সমর্থনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পীরপৈতিতে ইংরেজ বাহিনীর পরিণতি তারা তাদের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। সুতরাং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তারা সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেয়।