গোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল আত্মকলহ শুরু হল। কেননা ভ্ৰষ্টাচারে নিমগ্ন জাতি রক্তদানের মতো পবিত্র কর্মে কখনো একমত হতে পারে না।
রহু বলে, যারা আমাকে অনুসরণ করবে না তারা চিরকাল এই বহিরাগতদের কাছে অন্ত্যজ এবং দাস হয়ে থাকবে। যারা আমাকে অনুসরণ করবে তারা অবশ্যই একদিন আবার পুরনো সমৃদ্ধি খুঁজে পাবে।
এই বলে সে প্রবল শিঙ্গাধ্বনি করে এগিয়ে চলল। গোষ্ঠীর এক অংশ তাকে অনুসরণ করল, অন্যেরা উপহাস করতে লাগল। কিন্তু রহু এগিয়ে চলল। নদীর কাছে এসে স্বজনদের সে বলল, আমি চিরকাল তোমাদের সহায় থাকব। এখন এস, এই নদীকে আমরা পুনরায় অধিকার করি।
কিন্তু বহিরাগতদের সৈনিকেরা তাদের পথ আটকাল। প্রথমদিনের সেই পুরুষ এসে প্রতিরোধ করল রহুকে। বলল, চণ্ডাল, এ নদী স্পর্শ করলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
রহু বলল, তোমার স্পর্ধা থাকে প্রতিহত করো আমাদের।
সেই ব্যক্তি প্রবল অঙ্গাঘাত করল ব্লহুর বক্ষদেশে। তার দেহ ছিটকে পড়ল সেই নদীতেই এবং প্রবল গর্জন করে তার অনুগামীরা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে তার দেহকে অধিকার করতে।
রহুর ক্ষত থেকে জলস্তম্ভের মতো উদ্ভুিত হতে লাগল রক্ত এবং সেই রক্তের প্রবল বন্যায় নদীর জলে উঠল কেঁপে। সেই রক্তের নদী বহিরাগতদের নগরী, দলত্যাগীদের ভূখণ্ড সব গ্রাস করে ধ্বংস করল। কেবল রহুর অনুগামীরা তার দেহকে আশ্রয় করে ভেসে গেল দূর দূরান্তে।
অবশেষে বন্যার বেগ মন্দীভূত হলে তারা একদিন তীর খুঁজে পেল এবং রহুর দেহের অস্থির কয়খানি আশ্রয় করে নতুন পথে পা বাড়াল।
দনু বলে, পীতেম, রহু আমাদের সঙ্গে থাকেন, আমাদের রক্ষা করেন, নতুন ভূখণ্ডে আমাদের সুস্থিতি না করিয়ে তার তো মুক্তি নেই।
১৭.
পরদিন গাছতলায় পীতেমের কাছে সালমা আসে। তার হাতে নেকড়ায় জড়ানো ধন্দুর নবজাত পুত্র।
ধন্দুর ছেলে, দেখ পীতে।
পীতেম হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, হাসে, তার চোখ চিকচিক করে। রহু! রহু!
পীতেম আঙুল দিয়ে শিশুর অধর স্পর্শ করে। বিড়বিড় করে বলে, রহু রহু! পীতেম যেন তার গহ্বর থেকে আবার বেরিয়ে আসে। যদিও তার নিঃসঙ্গতা কাটে না তবুও সে দু-একটা কথা বলে অন্যদের সঙ্গে এবং মাঝে মধ্যে ধন্দুর ছেলেকে তাঁবুর ভিতরে গিয়ে দেখে এবং আদর করে। সে সালমার কাছে যায় ও অত্যন্ত আস্তে আস্তে বলে, নাতির দু-মাস বয়স হলে চলে যাব এখান থেকে, বুঝলি?
সালমা এখন আর তাকে তির্যক ইঙ্গিত করে না। এর আগের স্থানত্যাগের সিদ্ধান্তগুলো বিফল হয়েছে, তার জন্য পীতেমকে দায়ী করা চলে না। একটার
পর একটা বিপদ এসেছে। পরিকল্পনা ভেসে গেছে।
পীতেম বলে, যাব পুবে, কি যাব কোন জায়গায় সেটা তুই স্থির করবি।
পীতেম যেন আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। ধন্দুর ছেলের জন্ম অবশ্যই এর প্রধান কারণ। জন্ম এমন একটি বিষয়ে যে মৃত্যুপথযাত্রীকেও অন্তত কিছু সময়ের জন্য উজ্জীবিত করতে পারে, আর পীতেম তো ছিল শুধু বিস্মরণের মধ্যে।
সালমা বলে, যাব তো, কিন্তু ছেলেরা?
আত্মবিস্মৃত পীতেম ছেলেদের কথা কিছুই মনে করতে পারে না।
ছেলেরা?
ছেলেদের তো দারোগা যুদ্ধে নিয়ে গেছে।
যুদ্ধ?
সাহেবদের সঙ্গে সাঁওতালদের যুদ্ধ হচ্ছে। ঘোড়ার খিদমৎ খাটার জন্য ছেলেদের নিয়ে গেছে দারোগা।
তবে?
এ তবের উত্তর সালমার কাছেও নেই। সে শুধু কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয়। পীতেম মাথা নাড়ে।
কিন্তু অপেক্ষা বেশিদিন করতে হল না। দিন চারেক পরে জানকীরাম সিপাই পাঠিয়ে পীতেমকে ধরে নিয়ে গেল।
পীতেম আবার বিহ্বল হয়। আবার তার চোখে মুহূর্তের জন্য অনির্দিষ্ট দৃষ্টি ফিরে আসে।
আবার কি কসুর, বড় হুজর? যে পাঁচজন লোককে তোদর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলাম, তারা কোথায়? সালমা বলে, এসবের মানে কি? তারা কোথায় তা তো তুমিই বলবে আমাদের।
আমি বলব, না? এই বাঁধ এই বুড়োকে। সালমা আতঙ্কগ্রস্ত হয়। এগিয়ে এসে হাত তুলে দারোগাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে। বলে, থামো, বড় হুজুর। ব্যাপার কি হয়েছে আগে জানতে দাও।
দারোগার এখন আর কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার দরকার ছিল না। এই মানুষগুলোর কারণে সে অপরিমেয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পাঁচজন অশ্ব তদারককারী বাজিকর বন্দীকে মুক্ত করেছে, চারজন সৈনিককে হত্যা করেছে এবং পালিয়েছে। ব্যাপার কি হয়েছে, এ মুহূর্তে এ ব্যাখ্যা দেওয়া তার কাছে অবান্তর। ক্ষমতাশালী মানুষের ক্রোধ অনেক সময় রক্তদর্শন না করে তৃপ্ত হয় না। যুক্তিতে হয় না, বুদ্ধিতে হয় না, ক্ষতিপূরণে হয় না, ক্ষমাতেও হয় না।
এরকম বিধ্বংসী ক্রোধ এখন জানকীরামের মস্তিষ্কে। রক্তদর্শন করতে চায়। সে হুংকারে, দাপটে ক্রোধ বৃদ্ধি করে এবং প্রহারের উদ্যম ও শক্তি বাড়ায়।
ব্যাপার কি হয়েছে আঁ? অ্যাই, এ মাগিকে হঠা এখান থেকে।
পীতেমকে বাঁধা হয়েছে একটা থামের সঙ্গে। সালমাকে একজন হাত ধরে হ্যাচকা টান দেয়।
সালমা ভুল করে। আকর্ষণকারী সেপাইয়ের কাছ থেকে সে হাত ছাড়িয়ে নেয় আচমকা শক্তিপ্রয়োগ করে। একেবারে দারোগার মুখের কাছে হাত নাড়ায় সে। কুদ্ধ সাপের মতো সশব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে।
কি করবে একে? মারবে? মারো, তোমার ক্ষমতা দেখি? দেখো, দারোগাবাবু, আমরা বাদিয়া জাত, আসমানের দেবতা আমাদের সহায় থাকে। অন্যায় কিছু করবে, প্রতিফল মিলে যাবে হাতে হাতে। তোমার ব্যাটার মরার কথা ভেবেছ? দয়ারাম ভকতের লাশে পিঁপড়ে ধরেছিল, মনে আছে?