পীতেম বলে, কেন, বাপ?
দনু বলে, সে তো এক বিরাট গল্প, পীতেম।
রহু তার মানুষ নিয়ে সেই ভূখণ্ডে থাকত, যেখানে জীবন ছিল নদীর মতো, নদীতে ছিল অফুরন্ত স্রোত, বনে অসংখ্য শিকারের পশু এবং মাঠে অজস্র শস্য। মানুষ ছিল স্বাধীন, সুখী।
তারপর সেই মানুষটা এল। তার চোখ স্থির, তাতে পলক পড়ে না। সে এসে প্রথমেই মাঠ থেকে রহুর সেরা ঘোড়াটি ধরে নিল।
–এই ঘোড়া আমার।
কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। সবাই তাকিয়ে দেখছিল তাকে। সে কিছু স্বতন্ত্র, বহুর মানুষদের সঙ্গে তার মিল নেই।
সে ঘোড়াটা ধরে নিল এবং তাতে সওয়ার হল। কিন্তু ঘোড়াটা তাকে সওয়ার করতে রাজি হল না। তাকে ছিটকে ফেলে দিল। সে ক্রুদ্ধ হল এবং আবার সওয়ার হল। ঘোড়া আবার তাকে ধুলোয় ফেলল।
ক্ষিপ্ত মানুষটা তখন কোষ থেকে খঙ্গ নিষ্কাশন করল। ঘোড়া তার সামনে ঘাড় সোজা করে বেয়াড়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ মানুষটা এক কোপে সেই দুর্বিনীত স্বাধীন ঘোড়ার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করল।
সব মানুষ হতবাক হয়ে গেল। এমন পাশবিক হত্যা সেখানে কেউ কোনোদিন দেখেনি। সবাই স্তব্ধ।
তখন সে মানুষটা হা-হা করে হাসল। তাতে সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ালো এবং তাকে শাস্তি দিতে চাইল।
অদ্ভুত! সেই মানুষটার চোখে মুখে কোনো আতঙ্ক নেই।
রহু তখন নিরস্ত করল তার মানুষদের! রহু সেই স্কন্ধহীন ঘোড়াটা দেখালো সবাইকে। সেই দুর্বিনীত ঘোড়াটা তখন সমস্ত মাঠ বৃত্তাকারে ঘুরছে। বৃত্ত ক্রমশ বড় হয়, ক্রমশ আরো বড়। ঊর্ধ্বমুখে উৎক্ষিপ্ত রক্ত সেই বৃত্ত তৈরি করে।
সব মানুষ সভয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। রহু তখন সেই আগন্তুককে বলে, তুমি ওকে মারলে কেন?
ও আমার অবাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ও তো তোমার পশু নয়।
সে হা-হা করে হাসে। সে বলে, আমি যা চাই, তাই পাই! তুমি পরিশ্রম করে অর্জন কর না?
সবাই অবাক হল তার উত্তর শুনে। সে বলল, আমি অর্জন করি আমার এই খগের সাহায্যে।
তারপর সে চলে গেল। যুবকেরা তাদের ধনুকে শরসন্ধান করছিল তাকে বিদ্ধ করার জন্য। রহু তাদের নিষেধ করল। কেননা, সে এই অদ্ভুত মানুষটাকে বুঝতে চেষ্টা করছিল। সে অমঙ্গল আশঙ্কা করছিল।
যুবকেরা বলেছিল, ওকে হত্যা করাই ঠিক ছিল, প্রবীণেরা বলেছিল, ওকে হত্যা করলে ওর স্বজাতির সৈনিকেরা এসে আমাদের হত্যা করত। রহু বলেছিল, ও এবার ওর স্বজাতীয়দের নিয়ে আসবে। ওকে হত্যা করা, না-করাতে কিছুই যায় আসে না। ওকে হত্যা করলে সৃণিত মানুষকে হত্যার কদর্যতা আমাদের গায়ে লাগত।
রহু ঠিক বলেছিল। সে আবার এল। এবার অনেক লোক-লস্কর নিয়ে। এবার রহু তার পথ আটকাল।
সে বলল, চণ্ডাল, পথ ছেড়ে দাও।
–কোথায় যাবে তোমরা?
–আমরা ঐ পবিত্র নদীর কাছে যাব।
রহু বলেছিল, ওই পবিত্র নদীর কাছে যাও, পবিত্র হও।
সে আবার হা-হা করে হেসেছিল। তারপর তারা সেই নদীর পথে এগিয়ে গিয়েছিল।
তারা সেই নদীর তীরে তাদের দেবতার মন্দির নির্মাণ করেছিল, তারপর ফিরে গিয়েছিল। ফেরার পথে তারা রহুর জনপদকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছিল, শস্য নষ্ট করেছিল, রমণীদের ধর্ষণ করেছিল এবং বাধাদানকারীদের হত্যা করেছিল। তারা ছিল মদমত্ত ও স্বেচ্ছাচারী।
তৃতীয়বার সে আসে আরো বলশায়ী হয়ে। এবার তার সঙ্গে ছিল তার পুরোহিতগণ। তারা সেই মন্দিরে তাদের দেবতা স্থাপন করল এবং তাদের বিচিত্র রীতিপদ্ধতির অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করল।
তারা তৃষ্ণার্ত রহুর স্বজাতিদের নদীর জল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। তখন রহু করল তার প্রতিবাদ।
একি স্বেচ্ছাচার তোমার?
চণ্ডাল, এই পবিত্র নদী তোমরা স্পর্শ করতে পারবে না। এই মন্দিরের ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না।
তোমার মন্দিরে আমাদের প্রয়োজন নেই, কিন্তু এই নদী এতকাল আমাদের fati
এখন আর নেই। এখন এ নদী আমাদের, তোমাদের স্পর্শে অপবিত্র হবে।
এই বলশালীর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তি কিংবা আয়োজন কিছুই ছিল না। রহুর জনপদের যাবতীয় সম্পদ, শস্য, পশু, এমনকি স্ত্রীদেরও আগন্তুকরা বলপ্রয়োগে দখল করল। তারা ক্রমশ হীনবল হয়ে দখলকারীদের বিধিনিষেধের মধ্যে অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে লাগল।
অবশেষে, রহু একসময় আবিষ্কার করল, বহিরাগতদের যাবতীয় ভ্ৰষ্টাচার তার নিজ গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করেছে। সে তখন গোষ্ঠীর সবাইকে নিজের কাছে ডাকল।
আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারিনি। আমি হিংসাকে নির্দিষ্ট করেছিলাম খাদ্য সংগ্রহের নিমিত্ত পশু শিকারের মধ্যে। কিন্তু এই জনপদের বাইরেও পৃথিবী আছে, সেখানকার বিধিনিয়ম পরিবর্তিত হয়েছে, সে খবর আমি রাখিনি। সেখানে হিংসা শুধু পশু শিকারের জন্য নয়। আমি তোমাদের শিখিয়েছিলাম যে, মানুষ মাত্রেই তোমাদের ভাই, কিন্তু এ শিক্ষা ভুল। এই নবাগত মানুষেরা কখনো আমাদের ভাই হতে পারে না। এরা আমাদের অন্ত্যজ করেছে, আমাদের পবিত্র নদীর স্পর্শ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে, আমাদের মধ্যে ভ্রষ্টাচারকে প্রবেশ করিয়েছে।
প্রবীণেরা, বলল, রহু, কেন আমাদের এমন হল?
রহু বলে, সমৃদ্ধি আমাদের বড় বেশি আত্মসন্তুষ্ট রেখেছিল। আমরা অসতর্ক হয়ে পড়েছিলাম। প্রাচীনদের অর্জিত জ্ঞানকে আমরা ধারাবাহিক করিনি। তাই আমাদের এ হেন দুর্গতি।
রহু, এই অসম্মান এবং অধঃপতন থেকে রক্ষার উপায় কি?
রহু বলে, এই অসম্মান এবং অধঃপতন থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের প্রাচীন অধিকার এবং সমৃদ্ধিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তার জন্য আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অনেক রক্ত দিতে হবে আকাশের দেবতাকে।