পরতাপ বলে, লড়াই থোড়াই করব আমরা। তুমি সত্যি বলছ, কাকা, ওখানে ডুমকা আছে?
আছে না?
ডুমকা আর আমি বাঘের সঙ্গে লড়াই করেছিলাম। মনে আছে?
চেতন মাঝি অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার দৃষ্টি পীরপৈতি পাহাড়ের দিকে। সে আর কথা বলে না।
ঠিক এই সময় প্রথমবার কামানের গম্ভীর গর্জন শোনা যায়। চেতন মাঝি চঞ্চল হয়ে ওঠে। শিকল ঝনঝন করে শব্দ করে। উত্তেজনায় সে উঠে দাঁড়ায়। পাঁচ বাজিকরের চোখে যুদ্ধের চেহারা পাল্টে যায়।
মেজর বারোজ চিন্তাই করতে পারেনি তার সমরসজ্জার এত কাছে সাঁওতালরা। প্রত্যেকটা পাথর, প্রত্যেকটা ঝোপ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ঝাকে ঝাকে ছুটে আসে তির। মেজর স্টুয়ার্ট তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে একেবারে ফাঁকা জায়গায়। দু-দিকে কাঁটাগাছের জঙ্গল। গাছের ও পাথরের আড়াল থেকে তির আসছে বৃষ্টিধারার মতো।
দু-পক্ষের প্রবল রণহুংকার এবং আর্তনাদ বহুদূর থেকে শোনা যাচ্ছে। পাহাড়ের নিচে অপেক্ষমাণ ঘোড়াগুলো পা দাপাচ্ছে। নালার কাছে সৈন্যরা তীরবিদ্ধ হয়ে পালাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। ইংরেজদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে সাঁওতালরা উন্মাদের মতো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তির-ধনুক আর টাঙ্গি-বল্লম নিয়ে।
চেতন মাঝি এবং পাঁচজন যুবক দূর থেকে দেখল পাহাড়ের মাথার উপর মেঘ জমেছে ঘন কালো রঙের। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম হাওয়া প্রবল বেগে সেদিকে ধেয়ে চলল। চেতন তার ভারি শিকল নিয়ে নাচতে শুরু করল—নাম, নাম, আকাশ ভেঙে নাম!
কামানের গর্জনকে ছাপিয়ে মেঘের গর্জন উঠল। বাজ পড়তে লাগল মুহুর্মুহু। বারুদের ও গন্ধকের গন্ধে বাতাসকে ভারি করে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। পীরপৈতির নালা দিয়ে প্রবলবেগে ঘোলা জল গর্জন করে হতাহত ইংরেজ সৈন্যকে ভাসিয়ে ছুটে চলল। মেজর বারোজ এ অবস্থায় আর যুদ্ধ চালানো নিরাপদ মনে না করে পিছু হটতে শুরু করে। এদিকে সাঁওতাল বাহিনী পিঁপড়ের সারির মতো পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে। ইংরেজ সৈন্য দ্রুত পিছিয়ে এসে পিয়ালাপুরের রাস্তায় উঠল। তারপর পলায়ন।
সাঁওতালরা কিছুদূর পশ্চাদ্ধাবন করে ফিরে গেল। কেননা পাহাড়ের উপরে আহত ও নিহতদের ব্যবস্থা করতে হবে। যার মধ্যে আছে বীর শ্যাম পারগানা।
পরাজিত ইংরেজ বাহিনী পিয়ালাপুরে এসে আর বিশ্রাম করতেও সাহস পেল all
ভাগলপুর ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হল। আকাশে যেমন ঘনঘটা তেমনি অন্ধকার। ঝড় ও বৃষ্টিতে দিকনির্ণয় করা যায় না। তখন খোঁজ পড়ে চেতন মাঝি নামে সেই বন্দীর।
মশালের আলোয় অস্থায়ী আস্তাবলে দেখা যায় আরেক দৃশ্য। ছুরিবিদ্ধ চারজন সিপাই মৃত। একটু দূরে বন্দুকের গুলিতে নিহত ধন্দু বাজিকর। পাঁচটি ঘোড়া এবং বন্দীকে নিয়ে চার বাজিকর যুবক দুর্যোগ ও অন্ধকারের মধ্যে কোথা মিলিয়ে গেছে।