তারপর সালমা তাকে আফিং খাওয়ানো শুরু করল। আফিঙের নেশায় সে খানিটা স্বস্তি পেয়েছিল। দিনরাত একটা আচ্ছন্ন একাকিত্বের সে বিভোর হয়ে থাকত। তার চুল দাড়ি ক্রমশ বড় এবং ঝকড়া হয়ে তাকে ক্রমশ এক বিজ্ঞ প্রবীণ মানুষ বানিয়ে দেয়। আফিং খাওয়ার অনুষঙ্গ হিসাবে সে স্নানও করত না, ফলে তার গায়ের রঙ একটা সবুজ শ্যাওলার ভাব এসে পড়ে।
এরকম সময় একদিন দারোগা জানকীরাম ছাউনিতে এসে হাজির হয়। পীতেম অর্ধনিমীলিত চোখে তাকে দেখে। তার দৃষ্টিতে পরিচিতির কোনো লক্ষণ নেই। সুতরাং এগিয়ে সে কথা বলতে হয় সালমাকেই।
বেশ কয়েকজন ইংরেজ সাহেব তখন শহরে ছিল। তাদের মধ্যে একজন মেজর বারোজ। সাঁওতালদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য লোকজন সংগ্রহ চলছে। সে কাজ বারোজ সাহেব নিজে তত্ত্বাবধান করছে। জানকীরামের আসার উদ্দেশ্য ঘোড়ার খিদমৎ করার জন শিক্ষিত লোক অন্বেষণ। বাজিকরদের থেকে সে কাজ আর ভালো কে জানে। সুতরাং তোক দিতে হবে।
সালমা বলতে চেষ্টা করেছিল কয়েকটা কথা কিন্তু শোনে কে? দারোগা বলে, কথা বলার এবং শোনার সময় আমার নেই। এমনি যদি না যেতে চাও, বেঁধে নিয়ে যাব, তাও না যেতে চাও, আগুড় দিয়ে সমস্ত ছাউনি পুড়িয়ে দেব।
ধন্দু, বালি, পরতাপ, পিয়ারবক্স এবং জিল্লু এই পাঁচজন মনোনীত হয়। বারোজ তাদের নিজে পছন্দ করে। বাজিকরদের পাঁচ সেরা যুবক যুদ্ধে যায়।
তবু ছেড়ে যাওয়ার আগে তারা সবাই গাছতলায় পীতেমের কাছে এসে দাঁড়ায়। পীতেমের সেই একই অনির্দিষ্ট অর্থহীন দৃষ্টি। যেন সে কানেও শোনে
এমনভাবে সালমা তার কানের কাছে চিৎকার করে, সাহেবরা ছেলেদের যুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে। পীতেম, শুনতে পাচ্ছিস। সাঁওতালদের সঙ্গে সাহেবদের যুদ্ধ হচ্ছে।
পীতেম মাথা নাড়ে, তার শরীর থেকে প্রাচীন রহস্যময় গন্ধ ছড়ায়, সে আবার ঝিমোয়, যেন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।
যুবকেরা একে একে তার পা স্পর্শ করে, পীতেম টেরই পায় না যেন। তার পর তারা বিদায় নেয়।
১৫.
উত্তরে গঙ্গা এবং দক্ষিণে বনভূমি অঞ্চল। মাঝে মাঝে অনতিউচ্চ গিরিমালা। এমন জায়গায় গ্রীষ্মের আবহাওয়া বড় অকরুণ হয়। ইংরেজ বাহিনী সাঁওতালদের মুখখামুখি হওয়ার জন্য শিবির করেছে এমনই একটি জায়গায়। স্থানটির নাম পিয়ালাপুর। পিয়ালাপুরের পুবে রাজমহল এবং পশ্চিমে ভাগলপুর প্রায় সমান দূরত্বে। ভাগলপুরের কমিশনার চায় এখানে সাঁওতালদের একটা মারণ আঘাত হানতে। কারণ এখানে যদি বিদ্রোহীদের আটকানো না যায়, তাহলে ভাগলপুর রক্ষা করা যাবে না। বাহিনীর নেতৃত্ব করছে ছজন ইংরেজ অফিসার, তারা হল মেজর বারোজ, মেজর স্টুয়ার্ট, কর্নেল জোন্স, চার্লস ইজারটন, জেমস পস্টেট এবং এডেন।
পিয়ালাপুরে অস্থায়ী ঘাঁটি হল। পথপ্রদর্শক হিসাবে এক বৃদ্ধ সাঁওতালকে বন্দী করে আনা হয়েছিল। সংবাদ ছিল যে পীরপৈতি গিরিসংকটে সাঁওতালদের ঘাঁটি। ঘাঁটিতে রসদ ও খাবারদাবারসহ কিছু সৈন্যকে অপেক্ষায় রেখে ঠিক দুপুরবেলায় মেজর বারোজ গিরিসংকটে প্রবেশ করে সৈন্যসমাবেশ করল। রাস্তা অত্যন্ত দুর্গম, পাথর ও আগাছার জঙ্গলে ঢাকা। পাহাড়ের নিচে আছে একটা নালা। আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হলে তার যাবতীয় জল প্রবল বেগে বেরিয়ে যায় সেই নালা দিয়ে। পাহাড়ের উপর দিকে কোনোরকম চাঞ্চল্য নেই। যতটা সম্ভব অগ্রসর হয়ে মেজর বারোজ কামান পাতল স্থানে স্থানে।
পিয়ালাপুরের অস্থায়ী ঘাঁটিতে জিল্লু এবং পরতাপ তখন বৃদ্ধ বন্দীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। জিল্লু বলেছিল, বুড়ো তুমি বেইমানি করলে? রাস্তা দেখিয়ে দিলে সাহেবদের? বৃদ্ধ এতক্ষণ দূরের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই হাসছিল। তার হাত-পায়ের শৃঙ্খলকে সে যেন আমলেই আনছিল না।
জিল্লুর কথা শুনে সে বলে, হা, রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছি, একেবারে যমের দক্ষিণ দুয়ার।
বৃদ্ধের দড়ির মতো শীর্ণকায় চেহারা, খোঁচা খোঁচা কয়েকটা মাত্র দাড়ি, অযত্নবর্ধিত চুল সারা মুখে ছড়ানো।
সে হঠাৎ জিল্লুর দিকে তীব্রভাবে তাকায়। তারপর বলে, ওখানে কে আছে, জানিস?
কে?
ওখানে যে আছে, তাকে দেখলে বাঘ রাস্তা ছেড়ে দেয়। তার নাম চাঁদ রাই। আর পশ্চিমের ঘাঁটিতে আছে শ্যাম পারগানা, যার নাম তোর সাহেবরা গোরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত মনে রাখবে। শ্যামের বাঁয়ে আছে ডুমকা সোরেন, যার ছোঁড়া তিরের ঢপলা যেখানেই বিধুক তা বাইরের আলো দেখবেই। বুঝলি? যা এখন, কানের পিছনের ঘা তো শুকিয়েছে, এবার সাহেবদের কাছে বলে আয়।
বৃদ্ধের নাটকীয় কথাবার্তায় জিল্লু ও পরতাপ পা পর্যন্ত চমকায়। কে এ মানুষটা? তারা দুজনে কাছে এসে ভালো করে দেখে। হায়রে, এই সেই মানুষ! এমন নাটক বুঝি যুদ্ধক্ষেত্রেই হয়!
সেই মানুষ, যার ধান ওজনের কারচুপিতে জিল্লু প্রতিবাদ করে মাথায় চোট খেয়েছিল। হাঁ, এ সেই চেতন মাঝিই বটে!
জিল্লু, পরতাপ দু-জনে আশপাশ দেখে নিয়ে কাছে এসে হাঁটু ছোঁয় তার।
চেতন মাঝি শৃঙ্খলিত হাত দিয়ে ঝটকা দেয়, থাক্ থাক্, সাঁওতাল মারতে এসেছিস!
নিজের ইচ্ছায় আসিনি মাঝি, জোর করে নিয়ে এসেছে।
জোর করে আবার কি আনে রে? মরদ নোস তোরা?
মাঝি ভীষণ উত্তেজিত হয়। বালি বলে, এই ধরো যেমন তোমাকে এনেছে। জোর করেই তো এনেছে? নিজের ইচ্ছায় তো আর আসনি?
চেতন মাঝি বালির দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকায়, তারপর হঠাৎ হেসে ফেলে। বলে একে দেকো, তার উপর বাজিকর। তোদের সাথে কথায় পারে কে? তবে লড়াইতে পারবি না। সাঁওতালরা তোদের কচুকাটা করবে!