সে ভেবেছিল, তার বাড়ি তিন মাথার মোড়ে। সেখানে গাছের গায়ে গরুর চামড়া, জোড়া বাঁশি এবং শালপল্লব সাজিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল তার, যাতে প্রমাণ হয় এ বাড়িটা সাঁওতালের, এ গ্রাম সাঁওতালের, তা না হলে বাঁচি না কোথায় যে নেতা জন্মে বড় হয়েছে যে যদি এসে এসব দেখতে না পায়, তাহলে ক্রুদ্ধ হয়ে সবাইকে হত্যা করতে পারে। সে মনে করেছিল, যেসব যুবক সাঁওতাল এখন পায়ে ঘুঙর বেঁধে টামাং নিয়ে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে প্রচার করছে এবং অন্যকে প্রচারে উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের দলে তার থাকা অবশ্যই উচিত ছিল। তার মনে হল, সে তো এক মায়ের এক বেটা, আর এখন সব এক বেটার মায়েরা পরস্পর সই পাতাচ্ছে। হয়ত, তার মাকে সবাই অবহেলা করছে এবং সই না পাতিয়ে নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। কেননা সে তত অন্যসব এক মায়ের এক বেটাদের মতো নির্ভীক হয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি।
এসব চিন্তা করার পর মাদি গাধাটাকে তার খুব ময়ীয়সী মনে হয়। সে তারপর মালিকের ঘোড়াটার বাঁধন খুলে তাতে সওয়ার হয়ে বসে। ঘোড়াটা দীর্ঘকাল সওয়ারকে এককাতে বসিয়ে আস্তে চলতে অভ্যস্ত। এখন দু-পা ঝোলানো সওয়ারী পেয়ে একটু বেকায়দা বোধ করে। সুফল দু-গা চাবুক চালিয়ে বলে, চল বেটা, আজ মনের আনন্দে ছোট। ঘোড়া গ্রামের পথে ছুটতে শুরু করে।
১৪.
দলের হালচাল সম্বন্ধে অনেকদিন ধরেই পীতেম আর মনোযোগ দেয় না। নানা ধরনের আপদ-বিপদে একেই তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল, অবশেষে পেমার মৃত্যু তাকে মারাত্মক আঘাত দিয়ে যায়। তাছাড়া অনেক চিন্তা করেও দলের মতিগতি এবং অবস্থা ফেরাবার মতো কোনো বুদ্ধি তার মাথায় আসেনি।
সেই মেলার সময় যে বড় খেলা হয়েছিল তখন ইউসুফ নামে এক মুসলমান যুবক একদিন খেলার শেষে হাত ধরে বালিকে একধারে টেনে এনেছিল। হাত দু-খানা একত্র করে ঝুঁকে পড়ে সে চুম্বন করেছিল। মুখে অকুণ্ঠ বাহবা ছিল তার।
ইউসুফ বলেছিল, কি হাতই বানিয়েছ ওস্তাদ, ইচ্ছে হয় সোনা দিয়ে মুড়ে রাখি।
এসব বীরাচারের স্তুতিতে সব বীরেরাই বিগলিত হয়। বালিও হয়েছিল। তারপর ইউসুফের সঙ্গে দোস্তি হতে তার দেরি হয়নি।
কিন্তু ইউসুফের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। দু-একদিনের মধ্যেই সে কথাটা পাড়ে বালির কাছে। বালির মতো এক-আধজন লোক তার দরকার। এসব ডুগডুগি বাজানো হেঁচড়া কাজে বালির মতো ওস্তাদের সময় নষ্ট করা অন্যায়। বড় কাজ কিছু করতে চায় তো বালি আসুকর সঙ্গে। যে কাজে সাহস লাগে, উত্তেজনা ও পয়সাও ভালো আছে।
বালি বলেছিল, আদরে-পাদারে ঢিল না ছুঁড়ে আসল কথাটি বল। আমার ছুরি কেমন সোজা এবং জায়গামতো যায়, দেখেছ তো? আমি মানুষটাও সেরকম।
তারপর ইউসুফ মনের কথা খুলে বলেছিল। গঙ্গায় আছে অনেক মহাজনি নৌকো। দেশবিদেশের ব্যবসাদারেরা। এখানে হরেকরকমের মাল বোঝাই করে। প্রশস্ত গঙ্গার অন্ধকার রাতগুলো ইউসুফের। মানুষ আজকাল ভীষণ ত্রাসে থাকে। পাহারাদারগুলো টের পেলেও রা কাড়ে না। সেখান থেকে পাঁচ-দশ পেটি মাল সরালে দিব্যি মাসখানেক নিশ্চিন্তে বসে খাওয়া যায়। আর এসব কাজের সুসন্ধান ইউসুফের ভালোই জানা আছে। যা করার সেই করবে। বালি শুধু সঙ্গে থাকবে তার।
প্রস্তাব শুনে বালি ভয় পেয়েছিল। সে বলেছিল, না ভাই, দলে থেকে এসব হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে চাই না। আমার একার দোষে দল নষ্ট হবে, এ ঠিক নয়।
ইউসুফ অবশ্য বেশি পেড়াপিড়ি করেনি। যাওয়ার সময়ে বলে গিয়েছিল, গেলে ভালো করতে, না যাও, ইউসুফ মিয়ার আটকাবে না। এ দুনিয়ার বোকা লোকেরা খেটে মরে আর বুদ্ধিমানেরা বসে খায়। আর আমার মতো তোমার মতো, যারা খাটতেও চায় না আবার পয়সা রোজগার করার মতো অনেক বুদ্ধিও নেই তারা সাহস দিয়ে রোজগার করে। কথাটা তোমার কাছে ভোলা রইল, ভালো মনে কর, খবর দিও একসময়।
বালি কথাটা তখন ভালো মনে করেনি। এখন এই দুর্দিনে কথাটা ভালো মনে করলেও একেবারে ফেলনা মনে হয় না। কাজেই সেই ইউসুফের খোঁজ লাগায়।
অস্থিরতার সময় সব ধান্দাবাজরা শহরেই থাকে। ইউসুফও তার ব্যতিক্রম নয়। কাজেই তাকে খুঁজতে বালির বেগ পেতে হয় না।
ইউসুফ বলে, আমি জানতাম তুমি আসবে। খুব ভালো সময়ে এসেছে। ঘাটে নৌকো রাখার জায়গা নেই। গুদামগুলো ভর্তি। সাঁওতাল হাঙ্গামার ভয়ে কোনো মহাজনই এখন নৌকো ভাসাতে রাজি নয়। তার উপরে দেখ কেন, ঘাটের দিকে থানা পুলিশ পাহারাদারের নজর নেই। নজর এখন সবার গ্রামের দিকে। সবারই ভয় কোন দিক দিয়ে কখন এসে জংলিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
প্রথমে বালি একা, তারপরে ধন্দু, পরুপ, জিল্লু ইত্যাদিরাও এসে যোগ দেয়। অন্ধকারের মধ্যে বোঝাই নৌকো থেকে মালের পেটি তুলে নিজের নৌকোয় তোল। তারপর ভাঁটির দিকে তরতর করে বেয়ে যাও। মাইল দুয়েক তফাতে বড় বজরা অপেক্ষা করে থাকে। সেখানে মাল ফেলে দিলেই ছুটি আর নগদ টাকা।
এভাবে চলছিল সেই গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। পীতেম আফিঙের নেশা করত এবং ঝিমোত। নতুন করে কিছু চিন্তা করার কথা আর তার মাথায় আসত না। হাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আস্তে আস্তে সে একেবারেই গম্ভীর হয়ে যায়। জাগ্রত ও ঘুমন্ত দুই অবস্থাতেই তার কানে সারারাতব্যাপী পেমার আর্তনাদ এসে আঘাত করত। সে ছটফট করত, তাঁবুর বাইরে সারারাত পায়চারি করত এবং একা বিড়বিড় করত। সে কারো সঙ্গে কোনরকম পরামর্শ করত না এবং কথাও সারাদিনে মাত্র দু-একটা বলত। তাঁবুর সামনে একটা গাছের গোড়ায় সে প্রায় সারাক্ষণই বসে থাকত।