প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন গুজব ছড়ায়। যে কথা সালমা একদিন ঘোরের মধ্যে উচ্চারণ করেছিল, কি করে যেন সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। হয়ত সালমা আরো কারো কাছে কথাটা বলেছিল, এখন সে কথা সাঁওতাল গ্রামে মুখে মুখে ফেরে। হাজার হাজার নাগ-নাগিনী উড়ে আসছে। তাদের নিশ্বাসে বিষ। সেই বিষ-নিশ্বাসে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এসব কথা মানুষ বিশ্বাস করত।
বাজিকরের ছাউনিতে এখন ঘোর দুর্দিন। চতুর্দিকে এত বিশৃঙ্খলা যে দল আর এখানে-সেখানে ঘুরে, খেলা দেখিয়ে বিশেষ কিছু রোজগার করতে পারছে না। যে যার সঞ্চয় খেয়ে শেষ করছে। অথচ নতুন রাস্তায় পা বাড়াতেও সাহস করছে না।
সালমা যখন পীতেমের কাছে এসে পেমা-আনন্দ বৃত্তান্ত বলে, তখন সে আশা করেছিল, পীতেম বোধহয় এবার তার প্রস্তাবে রাজি হবে। সে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেই রাত্রেই পালিয়ে যাবার। সে ভেবেছিল, বাপ হিসাবে পীতেম হয়ত পেমাকে বাঁচাবার কথা ভেবে তার মতে সায় দেবে। কিন্তু পীতেম রাজি হয়নি। সে গৃহী মানুষের মতো আতঙ্কিত হয়েছিল। কোথায় যাব পালিয়ে? কোম্পানির রাজত্বে পালাবার জায়গা নেই। গর্ত করে ঢুকে থাকলে বেতআঁকড়া দিয়ে সেখান থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসবে।
কাজেই সে জানকীরামের অপেক্ষুম্ভ ছিল। জানকীরাম আসেনি। কিন্তু অন্য পুলিশ এসে বাজিকর ছাউনি তছনছ করেছিল। পীতেম, ধন্দু, পরতাপও গ্রেপ্তার হয়েছিল পেমার সঙ্গে। অত্যাচার চলেছিল সারারাত ধরে। পীতেম কিংবা কেউই জানত না এ সমস্যার সমাধান কোন পথে।
সমাধান পেমাই করে দেয়। চরম শাস্তি হিসাবে পেমাকে রাখা হয়েছিল দাগি কয়েদিদের সঙ্গে। দারোগার ছেলে খুন, যে-সে অপরাধ নয়। সারারাত ধরে পেমার চিৎকার শোনা গিয়েছিল। ছ’দিন পরে পেমা মৃত সন্তান প্রসব করে এবং প্রচুর রক্তপাতে নিজেও মরে যায়। পীতেম, ধন্দু ও পরতাপ ছাড়া পায় সেদিনই।
এর থেকে আর স্বস্তির সমাধান কিছু ছিল না পীতেমের কাছে। পেমাকে যদি ছেড়ে যেতে হতো, তাহলে সারাজীবন একটা কাঁটা বুকের কাছে খচখচ করত।
এবার সে নিজেই সালমাকে বলে, গোছ জিনিসপত্র, গোটা তাঁবু, চল বেরিয়ে পড়ি।
১৩.
কিন্তু ‘চল’ বললেই যাওয়া যায় না। চারদিকে তখন যেসব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, তার উপরে করোরই কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না না! বাজিকর ছাউনিতে তখন অভাবটা সংকটের আকার ধারণ করেছে। গৃহস্থদের দেখাদেখি যা ছিল তার কতক বেচে খাওয়া হয়েছে, কতক বেচে পুলিশের হুজ্জতি বন্ধ করা হয়েছে।
এরই মধ্যে একদিন শোনা গেল কোথায় নাকি সাঁওতালরা সভা করেছে, তার পরে এক দারোগাকে সদলবলে খুন করে বন্দীদের ছিনিয়ে নিয়েছে। রাজমহলে তখন সরকারি মহলে ভীষণ চাঞ্চল্য শুরু হয়। থানা পুলিশ বন্দুক লাঠি সব জোরদার করা হতে লাগল। কেননা মানুষের স্মৃতিতে বাবা তিলকা মাঝির বিদ্রোহের কথা তখনো জাগ্রত ছিল।
হাওয়ায় গুজব এত ছড়াচ্ছিল যে পীতেম যেদিন শুনল দয়ারাম ভকত গাধার পায়ের চাট খেয়ে মরেছে, সে বিশ্বাস করেনি। সে ভেবেছিল বজ্জাত লোকটা বেঘোরে মরেছে কোনোরকমে, আর মানুষ রটাচ্ছে এই রকম। কেননা দারোগার ছেলের ঘোড়ার চাট খাওয়া ব্যাপারটা দুরদূরান্তের সবাই জেনে গিয়েছিল। কাজেই চাট খাওয়াটা মানুষ একটা সাধারণ ব্যাপার করে ফেলেছে। তাছাড়া, গাধা কখনো চাট মারে, এ কখনো কেউ শুনেছে? তবুও খোঁজ নিতে গিয়ে সে খুবই তাজ্জব বনে যায়। ঘটনাটা সত্যি। দয়ারামের খামারবাড়িতে দয়ারাম মরে পড়েছিল তার নতুন কেনা গাধার পায়ের কাছে। এত কাছে একটা মৃতদেহ মরে থাকাতে গাধাটা নাকি ভয়ে সারারাত চিৎকার করেছে। পরদিন মানুষ বিরক্ত হয়ে সেই খামার বাড়িতে গিয়ে দয়ারামের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে। কেউ বলছে দয়ারাম গাধার পায়ের চাট খেয়ে মরেছে, কেউ বলছে তার চাকর সুফল তাকে খুন করে পালিয়েছে। সবিস্তারে সব শুনে পীতেম সালমার কাছে এসেছিল।
দয়ারামের মরার খবর শুনেছিস?
শুনেছি।
সালমার মুখে কোনোরকম ঔৎসুক্য ছিল না। কিন্তু পীতেম এত সহজে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। এই আশ্চর্য ঘটনার পেছনে সালমার হাত সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। অথচ সালমা যেন কিছুই জানে না।
পীতেম, সালমা, বা অন্য কেউই জানত না সেদিন দয়ারামের নতুন কেনা মাদি গাধাটা আরেকজন মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। সে মানুষটা দয়ারামের সেই বাঁধা দাস সফুল মুর্মু। খামারবাড়িতে গাধা নিয়ে মালিক ব্যস্ত ছিল, তখন সে বন্ধ দরজায় মালিকের নির্দেশমতো পাহারা ছিল। কিছু একটা সন্দেহ হওয়াতে ফোকর দিয়ে উঁকি দিয়ে সে যা দেখেছিল, তা তার জাতের কেউ কখনো দেখেনি। তারপর চা খেয়ে জলচৌকির উপর থেকে মালিককে ছিটকে পড়তে দেখেছিল সে। তারপর আবার আবার চাট। তখনো সে ভেতরে ঢোকেনি, কেননা, না ডাকলে ভেতরে ঢোকা নিষেধ ছিল মালিকের। শেষে একসময় নিঃসন্দেহ হয় যে, মালিক আর ডাকবে না।
তখনো সে ঢোকেনি। সে ভেবছিল, গাধাও গা-জোয়ারী কিংবা বদমাইসি সহ্য করে না, অথচ সে সুফল মুর্মু আজ দশ বছর ধরে এই জানোয়ারের অধম মানুষটাকে সহ্য করে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল, পরপর সাতদিন স্বর্গের ঠাকুর আকাশ থেকে সিদুকানুর ঘরে এসে নেমেছিল, নির্দেশ দিয়েছিল। সে ভেবেছিল, তার ঘরের উঠোনে নিশ্চয়ই আগাছা আর ঘাসের জঙ্গল হয়ে আছে। যদি সেই অমঙ্গল চিহ্নিত মোষ আর কোথাও চরার জায়গা না পায়, তবে তার উঠোনে নিশ্চয়ই জেঁকে বসবে এবং ঘাস খাবে। কেননা তখন সব সাঁওতাল জানত এরকম মোষ আসছে। কোথা থেকে আসছে কেউ জানত না। তবু গ্রামে গ্রামে খবর রটে গিয়েছিল এবং প্রত্যেকটি বাড়িতে উঠোন চেঁছে গোবরজল দিয়ে সবাই পরিষ্কার করে রেখেছিল। কেননা ঘাস দেখলেই সেই অমঙ্গল বহনকারী মোষ তাতে চরবে, ঘাস খাবে। আর তাতে সবংশে সে বাড়ির মানুষ ধ্বংস হবে। সুফল মমুর বাড়ি আছে, বংশের মানুষও আছে, কিন্তু এখন আর কেউই সেই বাড়িতে থাকে না।