শেষপর্যন্ত পেমা তার পরিচারিকাকে শেষবারের মতো আনন্দর কাছে পাঠায়। বলে দেয়, যদি সে না আসে, তাহলে আমিই তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হব, এ কথা মনে রাখে যেন।
সুতরাং আনন্দ আসে। এবার শুধু বিরক্ত নয়, ক্রুদ্ধও সে। বলে, কি ব্যাপার, তুই যে বিয়ে করা মাগের মতো দাবি করছিস?
এখানে আস না কেন?
এখানে এসে কি হবে? আমার আর কাজকর্ম নেই?
তা বলে একেবারেই আসতে পার না?
তোর যদি এখানে ভালো না লাগে, তাহলে দলে ফিরে যা।
তার মানে?
তার মানে, তোকে যে সারাজীবন পুষতে হবে এমন কি কথা আছে?
সে কথাই তো ছিল।
না, সে কথা ছিল না, আর তোকে আমি ডেকে নিয়ে আসিনি। তুই নিজেই এসেছিলি। আমার এখন অন্য কাজ আছে, এসব ঝামেলা আর পোয়াতে পারব না, বুঝলি?
পেমা দপ করে জ্বলে ওঠে। চিঙ্কার করে বলে, বেইমান, এখন আমাকে চলে যেতে বলছিস, তো, এটার কি হবে, এটার? সে তার পেটের উপর চড় মারতে থাকে উন্মাদের মতো। জঠরের শিশু মোচড় মেরে ওঠে। পেমা অস্বস্তি ও যন্ত্রণায় মাটির উপরেই বসে পড়ে।
আনন্দ বলে, ওটার আমি কি জানি? বাজিকরের ছাউনিতে অমন বেজম্মা অনেক আছে। আজই এ ঘর খালি করে দিবি।
পরিচারিকাকে ডেনে আনন্দ বলে, এ যদি সন্ধ্যার মধ্যে ঘর ছেড়ে না যায় তবে ঘাড় ধরে বের করে দিবি। না হলে, তোদেরই তাড়িয়ে দেব, মনে রাখিস।
পেমা লাফিয়ে উঠে ক্ষিপ্তের মতো আক্রমণ করে আনন্দকে। দাঁতে নখে ঘায়েল করতে চায় সে। সঙ্গে অশ্লীল গালিগালাজ।
আনন্দ বলশালী পুরুষ। এক হাতে পেমার আক্রমণ সামলে অন্য হাতে মুখের উপর আঘাত করে বারবার। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
পেমা দরজার উপর থুথু ছিটায়, মা-বাপ তুলে খিস্তি করে, কাঁদে, তারপর বিছানার তলা থেকে একখানা ছুরি ঝট করে টেনে বের করে। বাজিকরের কামারশালার তৈরি ছুরি, মাথা ভারি, বাঁট ছোট। সে ছুটে যায় দরজার দিকে। পরিচারিকা তাকে আটকাতে সাহস পায় না।
আনন্দ তখন উঠোনে তার ঘোড়র কাছে। পিছনের চিৎকারে সে কান পাতে। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে পেমা ছুরি ছুঁড়ে মারে। ছুরিটা বিদ্যুৎ গতিতে আনন্দকে পাশ কাটিয়ে ঘোড়ার পিছনের নরম মাংসে বিদ্ধ হয়। ত্রাসে আনন্দ পিছন ফিরে তাকায় আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিপ্ত ঘোড়ার পিছনের পায়ের চাট খায় পরপর দু-বার। একটি আঘাতে তার মাথার খুলির খানিকটা ছিটকে বেরিয়ে যায়, সে সেখানেই পড়ে থাকে।
কয়েক মুহূর্ত পেমা হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর পরিচারিকার চিঙ্কারে তার চমক ভাঙে। আনন্দর দেহটা ছটফট করে এখন স্থির হয়ে আছে। ঘোড়াটি দড়ি ছিঁড়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। ভয়ংকর চোখে পেমা অপর স্ত্রীলোকটির দিকে এগোয়া। তার যাযাবরী রক্ত এবং ইন্দ্রিয় এবার পুরোপুরি ক্রিয়াশীল। স্ত্রীলোকটি ভয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ছুটে যায় চিৎকার করতে করতে।
পেমা তারপর দ্রুত তার অলংকার ও টাকা-পয়সা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তার গন্তব্য এখন পীতেমের ছাউনি। যাযাবর কি দলছাড়া বাঁচতে পারে?
পেমা যখন ছাউনিতে পৌঁছায় তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। দলের কেউ কেউ তাকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে দেখে, কিন্তু কথা বলে না। পেমা সালমার ছাউনিতে গিয়ে ঢোকে।
সালমা তাকে লক্ষ করতে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। পেমা বসেও তার অস্থিরতা দূর করতে পারে না। অবশেষে সালমা বলে, কি হল?
আনন্দ খুন হয়েছে।
কি করে?
পেমা সবকিছুই বলে। সালমা ধৈর্য ধরে শোনে, কোনোরকম অধীরতা দেখায়। তারপর পেমাকে ছাউনিতে রেখে সে পীতেমের কাছে যায়।
১২.
শীত শেষ না হতেই সে বছর হাওয়া উঠেছিল দুরন্ত। সূর্য যত চড়া হতে থাকে হাওয়াও বাড়তে থাকে। ফাল্গুন মাসে এত তাপ কেউ কখনো দেখেনি।
হাটে-বাজারে ফসল আসছিল অজস্র, কিন্তু নিমেষে সেসব উধাও হয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সারাদিন হাজার হাজার মণ মাল, যার প্রায় সবটুকুই খাদ্যশস্য ও তৈলবীজ। সেসব নৌকোয় বোঝাই হয়। এছাড়া চালান যায় রেশম ও তাঁতবস্ত্র। এত অজস্র উপকরণ, তবু মানুষ ধুকছে। রেশম, তাঁত, ধান, নীল প্রভৃতি সমস্ত উৎপাদন প্রচুর পরিমাণ দাদনের আওতায়। রাজকর্মচারীরাও ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রচুর দাদন খাটাচ্ছে। গঙ্গার ওপারে মালদার কালেক্টরের সঙ্গে লবণ ও বস্তুব্যবসায়ী সাহেবদের বিরোধ বাধে। কতকগুলো লবণের নৌকো বিভিন্ন জায়গায় জমিদারেরা আটকে দিয়েছিল। তাদের দাবি জমিদারকে খাজনা না দিয়ে জমিদারিতে লবণের ব্যবসা করা চলবে না। আবার অন্য এক জায়গায় দাদন নেওয়া তাঁতিদের উপর জমিদার খাজনা বৃদ্ধি করলে ব্যবসায়ী সাহেবরা কালেক্টরের উপর এসবের জন্য কৈফিয়ৎ ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কোন সাহেব কত ক্ষমতাশালী, কালেক্টর বড় না ব্যবসাদারেরা বড় এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন জায়গায়। সেইসব বিরোধ কলকাতা পর্যন্ত গড়ায় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানির কর্তারা কালেক্টরকেই অপদার্থ প্রতিপন্ন করে। কালেক্টরের সবচেয়ে বড় ত্রুটি রাজস্ব আদায়ে ধরা পড়ে। এ এমনই একটি কাজ যাতে কোনো কর্তৃপক্ষকে কখনো খুশি করা যায় না।
এ ছাড়া স্থানে স্থানে ছোটখাটো প্ৰজাবিদ্রোহ লেগেই আছে। আছে ছোট বড় জমিদার ও তাদের নায়েবদের হাতে আইনের ব্যাপারে কালেক্টরের নাস্তানাবুদ নানারকম ঘটনা। সবার উপরে সমস্ত দামিন-ই-কো, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম প্রভৃতি জায়গার সাঁওতালদের সংঘবদ্ধতার খবর।