মহী তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল তারা কত টাকা দিয়ে কতটা জমির পত্তনি নিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, এই জমি পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে তারা রাজি আছে কিনা, কিংবা অন্যান্য কৃষকদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে কিনা।
পীতেম দেওয়ালের মতো মুখ করে বলেছিল, না। এ সম্পর্কে আর কোনো আলোচনাই করতে সে রাজি হয়নি। কর্মকার মানুষটা এক সাহেব ডাক্তারের চাকর ছিল এককালে। সেই খানিকটা লেখাপড়া, নতুন আইনকানুন সম্পর্কে সামান্য কাণ্ডজ্ঞান এবং সরকারি মহলে ক্ষীণ একটা যোগাযোগ ইত্যাদির ভিত্তিতে কিছু চেষ্টা চালাতে চাইছিল, যাতে এই পাহাড়প্রমাণ অবিচারের কিছু সুরাহা হয়। পীতেমের বাস্তব অবস্থা, সে নিজে হতাশ হলেও, বোঝে এবং বলে যায় যে, যদি সফল হয় বাজিকরদের ভুলবে না। একথা শুনেও পীতেমের মুখের কোনো ভাবান্তর হয়নি।
মহী কর্মকার শেষপর্যন্ত খুন হয়েছিল। কিন্তু তার আগে কালেক্টর হ্যাচ সাহেবকে এ ঘটনার প্রতিকারের ব্যাপারে সে খানিকটা সচেষ্ট করতে পেরেছিল।
প্রজাদের নালিশ শুনে কালেক্টর হ্যাচ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের করে জঙ্গিপুর থেকে শ্যামলাল মিশ্রকে গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদ আনে। তারপর মোকদ্দমা উঠল তার নামে। কিন্তু চতুর শ্যামলালকে বাগে আনা এত সহজ হল না। টাকা দিয়ে সে হ্যাচের সহকারীদের হাত করল। তার উপরে বড় কথা, ঈশ্বরপুরের জমিদারের রাজস্ব বাকি পড়েছিল পরপর দু’ সন। যদিও এর কারণ শ্যামলাল নিজে, কিন্তু সে প্রমাণ করতে পারল বকেয়া রাজস্ব জমিদারের খেয়ালখুশিতেই রাজসরকারে জমা হয়নি, সে নির্দোষ। হ্যাচের সহকারীরা গোপনে লাটসাহেবের কাছে। কালেক্টরের বিরুদ্ধে চিঠি দিল। হ্যাচের বিরুদ্ধে রাজস্ব আদায়ের গাফিলতির নালিশ ছিল। হ্যাচ কিন্তু খুব দমবার পাত্র ছিল না। মুর্শিদাবাদ থেকে শ্যামলালকে সে ভাগলপুর নিয়ে গিয়ে মামলা স্থানান্তর করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শ্যামলাল বেকসুর খালাস পেয়ে জঙ্গিপুরে জমিদারি করতে ফিরে গেল। এর পরে কয়েকদিনের মধ্যেই মহী কর্মকার খুন এবং তার বাড়িঘর লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়।
এসব নজির সালমা খুবই নির্মোহভাবে পীতেমকে দেখিয়েছিল। পতেম তবুও রাজমহল ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারছিল না। তার ভিতরে যেন জড়ত্ব এসে গিয়েছিল। আগে সে সালমাকে বলেছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই বর্ষা আসছে। তাঁবুর নিচে দিয়ে যখন নদী বইবে, তখন আমার কথা বুঝবি।
জলকে বড় ভয় যাযাবরের। তাই বর্ষা আসার আগে, পীতেম ভেবেছিল, পাহাড়ের ঢালে দুঃসময়ের স্থায়ী ঘর তুলতে পারবে। দল না হয় ঘুরলই সারা দুনিয়া, কিন্তু অসময়, বর্ষা এবং দলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য থাকলই না হয় একটুকরো আশ্রয়। এসব সালমা বোঝে না। অধিকন্তু পক্ষপাতদুষ্ট আরো সব ঘটনা ঘটতে থাকে যা পীতেমকে বেশি বেশি করে আহত করে। সালমার যুক্তির কাছে সে দাঁড়াতেই পারে না। আসলে, সালমা তো কোনো যুক্তি বিশেষ দেখায় না। শুধু ইঙ্গিত দেয় সে, শুধু ছোটোখাটো দু-একটা মন্তব্য করে। সে-ই বা কী করে, ঘটনা যে ঘটছেই।
যেমন লক্ষ্মণ সোরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বালির। শুনে পীতেম অধোবদন হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। বিস্তারিত বিবরণ জানতে চায় তার অনেক পরে। হায় রে হায়, ঐরকম মানী লোকের হাতে হাতকড়া, পায়ে শেকল! কেন, কেন রে বালি? কিবা তার দোষ?
বালি দেখেছিল শৃঙ্খলিত লক্ষ্মণকে আমগাছির হাটে। সে হাটে তো সাঁওতাল মানুষই বেশি? তবে? হ্যাঁ, হাট সেদিন থমথমা ছিল। কালো কালো মানুষগুলো বোবা হয়েছিল। মদের ঠেকে, তাড়ির গদিতে, মোরগ-লড়াইয়ের জুয়ায় জনপ্রাণী নেই। হাটের বিক্রিবাটাও যেন বন্ধই। একটা পিপুল গাছের নিচে দারোগা বিশ্রাম করছিল। দু-জন চৌকিদার দুটো ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছে। একপাশে ক্লান্ত অবসন্ন এবং শৃঙ্খলিত লক্ষ্মণ আধশোয়া। পাথরের মতো মানুষটার শরীর যেন ভেঙে পড়েছে। শিকলের ঘষায় পায়ে লাল দগদগে ঘা। মাছিও তাড়াতে পারছে
লক্ষণ। গাছটা থেকে বেশ খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে মানুষের ভিড়, যার মধ্যে অধিকাংশই সাঁওতাল। লক্ষ্মণ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল অথচ দৃষ্টি তার অনির্দিষ্ট। সিপাইরা মাঝেমাঝেই ভিড় দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল।
বালি ভিড়ের ভেতরে নিজেকে গুপ্ত রেখে এসব দেখছিল। হঠাৎ একজন যুবক ভিড় ঠেলে দৌড়ে লক্ষ্মণের কাছে যায় এবং তার হাঁটু দু’হাত দিয়ে ছোঁয়, হাঁটুতে মাথা রাখে। একজন সিপাই ঘাড় ধরে তাকে ছিটকে ফেলে এবং ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়, চড়চাপড় মারে। আর কেউ এগোয় না। হঠাৎ লক্ষ্মণ উঠে দাঁড়ায়, তার শিকলে আওয়াজ হয় ঠনঠন করে। তার বুক ঘন ঘন ওঠানামা করতে থাকে। সে আচমকা চিৎকার করে ওঠে, আমি দেখতে চাই এই দারোগার কত শিকল আছে! আমি দেখতে চাই এই দারোগা সমস্ত সাঁওতাল জাতকে শিকল দিয়ে বাঁধতে পারে কিনা!
দারোগা একটু সতর্ক হয়। সিপাইরা লাঠি তুলে ভিড়ের কাছাকাছি গিয়ে হম্বিতম্বি করে। মানুষ দূরে সরে যায়। তারপর দারোগা এবং সিপাই ঘোড়ায় ওঠে, অন্যরা লক্ষ্মণের কোমরের শিকল ধরে টেনে নিয়ে যায় শহরের পথে।
হাট তারপরে আর জমেনি। মানুষ ক্রমশ সরব হয়ে দলে দলে ফিরে যেতে থাকে। শুধুমাত্র লক্ষ্মণের হাঁটুস্পর্শকারী সেই যুবক গাছটার নিচে একাকী অনেকক্ষণ বসে থাকে।
ফাঁক বুঝে বালি একসময় তার কাছে যায় এবং পাশে বসে। যুবকটি প্রথমে চমকে ওঠে, তারপর বিরক্ত হয়।