শারিবা লজ্জা পায়। দেওয়ালে, নিচু চালায় ছায়া কাপে। লক্ষ্যের আলো থেকে ধোয়া হয় বেশি। নানির শীর্ণ কুৎসিত অবয়ব দেয়ালে ভয়াবহ দেখায়, প্রেতিনীর মতো। বুড়ো কুকুরটা গুড়ি মেরে পায়ের কাছে শুয়ে আছে। বুড়ির কুকুর গোকো। গকোন বয়স বুঝি শারিবার মতোই। দীর্ঘ দেহ আর ঝোলানো কান নিয়ে গোকো অতীতকে পরে আছে। নাকি গোকোর মাথায় হাত রাখে। গোকো বুঢ়াটা হোই গলি, গোকা!’ গোকো হাই তোলে ও গুরগুর করে আদর উপভোগের স্বীকৃতি জানায়।
তারপর রাত বাড়ত। পাঁচবিবি গ্রামের বাইরে নদীর ধারে কুঁড়েঘরগুলোয় হঠাৎ দমকা হাওয়া লাগত। গোকোর কান খাড়া হতো। শারিবা নানির কোলের আরো কাছে ঘন হয়ে আসত। বাজিকর বোকা বটে। আশপাশের হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে বাজিকর বোকা, বাজিকর বজ্জাত। ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তে শারিবা এসব চিন্তা করত বারো বছর বয়সে।
তারপর নদীর পাড়ে দুই কুন্ঠিবাড়ির কোনো একটার হাতি নামত জল খেতে। দুই জমিদারের কুন্ঠি ছিল পাঁচবিবিতে। লালকুন্ঠির হাতিটা ছিল মাকনা আর চৌধুরীকুন্ঠির হাতিটা দাঁতাল। দুই হাতি একসঙ্গে যদি কোনোদিন এসে পড়ত, তাহলেই সর্বনাশ হতো।
মরণবাঁচন লড়াই লাগত মানা আর দাঁতালে। আশপাশের গাছপালা ভাঙত। বাড়িঘর ভাঙত। মানুষ মরত। গ্রামে মানুষ মশাল জ্বেলে, টিন বাজিয়ে হাতিকে ভয় সেখাত। এপারের মানুষ, ওপারের মানুষ সবাই সন্ত্রস্ত এবং সজাগ থাকত। ভীষণ চিৎকার উঠত। গোকোকে তখন বেঁধে রাখতে হতো।
গোকো সেভাবেই মারা যায় হাতির পায়ের নিচে পড়ে। কেননা সবাই তখন পালিয়েছিল। দুটো মত্ত হাতি কোনো বাধাই মানছিল না। গোকো বাঁধা ছিল, ত্রাসে সে খেয়াল কারোই ছিল না, নানিরও না। হাতি ঘর ভাঙছে, শনের ঘর, তালপাতার বেড়া, বাঁশের খুঁটি। গোকো মারা পড়ে।
এভাবে তিনবার ঘর ভাঙার স্মৃতি শারিবার সারাজীবন থাকে। কেননা, তার নানা জামির বাজিকর স্থিতিবান হতে চেয়েছিল। জামিরের পিতামহ পীতেম পুবের এই দেশটাকে বোধহয় ভালোবেসেই ফেলেছিল। সে তার দলবল নিয়ে শেষবারের মতো গোরখপুর ত্যাগ করার পর এদিকেই এসেছিল।
পীতেমের আগেও বাজিকরেরা এদেশে আসত, কিন্তু সে করতে চাইল চিরস্থায়ী গৃহস্থী। পীতেমের পরে বালি, তারপর জামির দলের সর্দারি পায়। জামিরের বাপ ধন্দু অল্প বয়সে খুন হয়। কাজেই লুবিনির স্মৃতিতে সে খুব উজ্জ্বল নয়। বাজিকর এমন অঢেল জমি, ধান এবং জল তার পরিচিত ভূমণ্ডলে কোথাও দেখেনি, যদিও বাজিকরের পরিচিত ভূমণ্ডল খুব ছোট ছিল না।
কিন্তু সেই ভূমণ্ডলে শস্যদানার বড় অভাব। বিশেষত বাজিকরের সারা দিনমান জন্তু-জানোয়ার নাচাও, দড়িবাজি, বাঁশবাজি কর, সন্ধ্যায় সেই ভিমেঙ্গে পাওয়া (‘হাঁ, শারিবা, ভিখ্-মাঙ্গা’) শস্যদানা ছাইপাশ সব মিলিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে ফুটিয়ে নেও। এই হল ধার্জিকরের খাওয়া। এসব নানির বলবার দরকার ছিল না, এসব শারিবা তখন নিজেই বুঝতে শিখেছে।
আর এজন্যই এর কিছুদিন পরেই শারিবা বুঝতে পারবে বাজিকর বাউদিয়ার স্বর্গে কেন এত অঢেল খাবার বন্দোবস্ত। নানি বলত, স্বর্গ শারিবা, সি এক আশ্চর্য জায়গা।
শারিবা বলবে, স্বর্গ কুনঠি?
নানি বলবে, সিটা তো জানা নাই, বাপ। জানা থাকলি তো কবিই চলি যাতাম। মরার পরে সেটি যাওয়া যায়।
তখন শারিবা একটা কথা বলবে, যা কোনদিন আর কোনো বাজিকর বাউদিয়া বলেনি।
শারিবা বলবে, তবি হামার ওঠি যাবার দরকার নাই, নানি। মরার পর আমার অঢেল খাবার খায়্যে কি হোবে?
এসব কথা অনেক পরের। তখনো গোকো মরেনি। তখনো চৌধুরী সাহেব “তুমরা হিন্দু না মোছলমান” এ প্রশ্ন তোলেনি। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হয়নি। তখনো লালকুন্ঠির ম্যানেজার মহিমবাবু “হাঁই বাপু, তোরা গরুও খাস, শুয়ারও খাস, ই কেম্কা জাত রে বাপো!” বলে আঁতকে ওঠেনি।
০২.
শনিবারের ভূমিকম্পের পর ঘর্ঘরার উত্তর তীরে সরে গিয়ে পীতেম আবার তার দলবল নিয়ে ডেরা তোলে। সে গ্রামটা ছিল গোয়ালাদের। তারা এসে বলে, বাজিকর, হেথায় থাকা চলবে না। তাদের হাতে মোটাসোটা বাঁশের লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে তারা খেপা ষাঁড় ঠাণ্ডা করে, জঙ্গলের জানোয়ার তাড়ায়।
পীতেম বলে, বাজিকর তো স্থায়ী বসবাস করে না। দু-চার মাস থাকব, ফের ঠে যাব। তোমাদের জমি তো দখল হয়ে যাচ্ছে না।
সে কথা কেউ শুনল না। তারা বাজিকরদের তিনদিনের মধ্যে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিল। পীতেম বলল, ঠিক আছে, যাব। সারা দুনিয়া বাজিকরের। জায়গার অভাব?
কিন্তু অন্যরা বলল, কিন্তু ভঁইস? কিন্তু ঘোড়া? খাব কি? যাব কি করে?
পীতেম ভাবতে থাকে, কিন্তু ভঁইস। কিন্তু ঘোড়া? খাব কি? যাব কি করে দেশ-দেশান্তর? শনিবারের ভূমিকম্প কিছুই অবশিষ্ট রেখে যায়নি। দলকে এখন বাঁচানোই মুশকিল।
দু-রাত্তির ঘুম হল না পীতেমের। দৈবদুর্বিপাক তার মনটাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। তৃতীয় রাতে অচেতুনের মতো ঘুমায় পীতেম। ঘুমের মধ্যে তার মরা বাণ দনু আসে তার কাছে।
শীতে হে, পীতেম?
বাপ?
চোখত্ পানি ক্যান বাপ?
পথেত্ যামো কেংকা বাপ? দল নষ্ট হোই যাবে, বাপ।
ক্যানে বাপ, তোর দুষ্টু কিসের?
ভঁইস কোই বাপ? ঘোড়া কই বাপ?
হাঁই দেখ, জঙ্গলের ধারে কত গাবতান ভৈঁসী ঘুরে বেড়ায়। হাঁই দেখ, কত জায়ান টাট্ট ঘুরে বেড়ায়। ওলা সব তুমার। দুনিয়ার বেবাক মাঠে চরা জানোয়ার তুমার।