নায়েব জমি বিক্রির টাকা মেরে দিয়েছে? জমিদারকে দেয়নি?
আঃ হা হা হা! মজা তো ঐখানেই। তোমর বাদিয়া লোক, জমির ব্যাপারে কিছুই বোঝ না। আরে জমি বিক্রি নয়, শ্যামলাল শুধু পাট্টা বিক্রি করেছে। আর কার জমি কে পাট্টা বিলি করে দেখ।
দয়ারাম প্রচুর উপভোগেরহাসি হাসে। সালমার কান তীক্ষ্ণ হয়, চোখের দৃষ্টি খর হতে সে নিজেকে শাসন করে। এই পাট্টা বিলির সঙ্গে বাজিকরেরাও যে জড়িত, একথা, দয়ারাম নিশ্চয়ই জানে না। জানলে এত আবেগ নিয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তার কথা কখনোই বলত না, একথা সালমা বোঝে। সে মুখে কৌতুকের ভাণ করে। বলে, ব্যাপারটা একটু খোলস ছাড়িয়ে বল তো ভকত, যাতে বুঝতে পারি।
দয়ারাম আকর্ণ হাসে। বলে, দেখ ওই পাট্টা সব ভূয়া পাট্টা! ওতে জমিদারের দস্তখত নেই, নায়েবেরও নেই। শ্যামলাল চাকরি ছাড়ার পর ঈশ্বরপুরের জমিদার ব্যাপারটা জেনেছে। মন্দার পাহাড়ের জমি এর মধ্যেই লাঠিয়াল দিয়ে জমিদার আবার দখল নিয়েছে। রাজমহলেও দেখ না ক-দিনের মধ্যেই কেমন ধুন্দুমার লাগে।
পাট্টাতে দস্তখত নেই?
তবে আর বলছি কি?
সালমার মুখ নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। বলে, হাজার লোকের সঙ্গে এভাবে বেইমানি করলে?
পয়সা কি আর এমনিতে হয় সুন্দরী? পয়সা এমনি করেই হয়।
দয়ারাম আবেগে সালমার চিবুক নাড়িয়ে দেয়। সালমা ঝটকা দিয়ে হাতটা সরাতে গিয়ে নিজেকে সামলায়। চেষ্টা করে হাসে। তারপর বলে, সত্যি বাবা, তোমার বুদ্ধি বটে!
সবই আছে ভান্মতি, শুধু এক জায়গায়ই ঘাটতি। এখন শুধু তোমার করুণা।
সালমা উঠে গিয়ে ঝোলানো বাঁশের ভাড় নিয়ে আসে। ভাড় থেকে মদ ঢেলে দয়ারামের সামনে ধরে। বলে, খাও।
দয়ারাম বলে, খাব? বল কি? আমার যে কণ্ঠি।
আরে খাও, ভকত। কতদিন আর নিজেকে শুকিয়ে রাখবে?
সালমা নিজে গলায় পানীয় ঢালে। বিস্বাদ পানীয়, মুখ কুঁচকে ঢোক গেলে সে।
দয়ারাম বলে, তবে খাই?
সালমা ধমকের সুরে বলে, খাও।
দয়ারাম মদ পান করে। বলে, তোমার হাতেই সব ছেড়ে দিয়েছি, ভান্মতি। এখন তুমিই ভরসা।
খানিক সময় নিশ্ৰুপ যায়। দু-জনের রক্তেই আস্তে আস্তে নেশা লাগে। দয়ারামের মদের নেশা নেই। ফলে, অতিদ্রুত তার উত্তেজনা বাড়ে। প্রগম্ভ হাসিতে তার ঠোঁট বেঁকে যায়।
এ কি ওষুধ দিলে ভাতি, শরীর যে টানটান লাগে?
সালমা বলে, ও কিছু নয়, ভকত, ও শুধু আরকের নেশা। নেশা কেটে গেলে আবার পুরনো মানুষ হয়ে যাবে।
তাহলে নেশা কেটে দরকার নেই, ভাতি, দেও আমাকে আরো নেশা দেও।
সে আরো পান করে। দয়ারাম এরকম উত্তেজনা জীবনে ভোগ করেনি। সে এবার ফিসফিস করে বলে, ভান্মতি, একটু সুখ দেও আমাকে একটু সুখ।
সালমা বলে, ওখানে চুপ করে বস ভকত, আমার কথা শোন। তাকত যদি ফিরে পেতে চাও তাহলে একটাই উপায় আছে। কিন্তু সে কি তুমি পারবে?
পারব, পারব।
এসব বানজারা-বাজিকরের গুপ্তবিদ্যা, তোমাকেই শুধু শিখিয়ে দেব। মন দিয়ে শোন।
দয়ারাম উত্তেজিত মস্তিষ্কে যথাসম্ভব একাগ্র মনে সালমার নিদান শোনে না তেমন কিছু অসম্ভব মনে হয় না তার। এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার? খুব পারব খুব পারব, ভান্মতি।
সালমা কিছু শিকড়বাকড়ও দেয় তাকে। তারপর একজন লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
১০.
পাট্টা বন্দোবস্তের টাকা শ্যামলাল মিত্র ও দয়ারামই শুধু খায়নি, খেয়েছিল আরো অনেক। শ্যামলাল এবং পাট্টাপ্রাপ্ত প্রজাদের মধ্যে ইজারাদার, দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার ইত্যাদি মধ্যবর্তীরাও ছিল। এ ছাড়াও ছিল সেরেস্তার গোমস্তা, তশিলদার ইত্যাদি আমলারা। যেসব জমিতে কোনোরকম জলের আয় আছে সেখানে বুভুক্ষু চাষিরা যেমন করেই হোক কলাই কিংবা তৈলবীজের চাষ করেছে। সেসব ফসল এখন সবে লকলকিয়ে উঠেছে।
ঠিক এই সময়েই কোনোরকম সাবধান না জানিয়ে ঈশ্বরপুরের জমিদারের লাঠিয়ালেরা সেইসব চাষিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেননা, নিয়মটা এমনই। দখল কিংবা বেদখল করতে হলে আচমকা সন্ত্রাস ছড়াতে হয়। জমি নিয়ে যাদের কারবার তারা এসব জানে।
কাজেই প্রথম চোটেই যে দু-চারজনের লাশ পড়ে তারা জানতেই পারে না তাদের অপরাধটা কি। ভূয়া পাট্টাপ্রাপ্ত কৃষিজীবীরা খবর পেয়ে এরপর লাঠি বল্লম নিয়ে এসে কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সে অল্প কয়েকজন মাত্র এবং তারাও শুধুমাত্র তাদের সর্বস্ব যাওয়ার কথাই চিন্তা করেছিল, আর কিছু নয়। কাজেই তাদের প্রতিহত করা আক্রমণকারীদের বিশেষ অসুবিধার ছিল না, বরং এতে তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি হয়। ফলে এরপর আক্রমণ হয় আশেপাশের গ্রামে এবং লাঠিয়ালেরা মাইনের উপরে ফাউ হিসাবে কয়েকশো গরু-মোষ ধরে নিয়ে চলে যায়।
পীতেম ও অন্য বাজিকরেরা দুরের থেকে এসব ঘটনা শুধু লক্ষ করেছিল, কোনোকিছু করার চেষ্টা করেনি। তারা অবশ্যই আগে থেকে এসব জানত। সালমা-দয়ারাম সংলাপ কারো কাছেই অজ্ঞাত ছিল না। সালমা আর একবার শুধু পীতেমকে অন্তরটিপুনি দিয়েছিল গেরস্থ হওয়ার দুরাকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দিয়ে।
পীতেম ভয়ানক দমে যায় এই ঘটনায়। চাষিদের নালিশই কেউ শুনছে না, কাজেই বাজিকরকে আর কে পাত্তা দেয়। যাযাবরের নালিশ কেউ গ্রাহ্য করে না, একথা যাযাবরের থেকে আর বেশি কে জানে? সুতরাং পীতেম বিষয়টা একেবারে হজম করে ফেলে, এ নিয়ে আর দ্বিতীয় বার কথা তোলার অধিকার দেয় না কাউকে। এমনকি যখন মহী কর্মকার নামে একজন মানুষ গোপনে তার কাছ থেকে এ সম্পর্কে যখন বিস্তারিত জানতে চায় তখনো সহসা মুখ খোলে না পীতেম।