পরতাপের এসব কাজে উৎসাহ বেশি। বহেরা গ্রামের কয়েক মাসের জীবনে (সে কি পেয়েছে কে জানে! গোমস্তা সীমানা নির্ধারণ করে দিলে জমির চৌহদ্দিতে পাপ গর্ত করে পাথর বসায়। সেই পাথর ধারালো অস্ত্রে খোদাই করে চিহ্ন রাখে।
পীতেম কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। সালমা ঠাট্টা করলেও সে হাসে। বলে, বর্ষার সময় তাঁবুর নীচ দিয়ে যখন নদী বইবে, তখন বুঝবি।
বর্ষা আসার এখনো সাত-আট মাস দেরি। কাজেই পত্তনি জমিতে ধীরেসুস্থে তোলা যাবে। এরকম ভাবে পীতেম।
অন্যান্য বাজিকরদের মধ্যেও পরিবর্তনের ঢেউ আসে। পীতেম জানে না, গোপনে তার দলের অনেকেই ছোটখাটো মহাজনি কারবার শুরু করেছে। আশেপাশের গ্রামের গরিব মানুষ, বিশেষত সাঁওতাল চাষি গেরস্থ ছাউনিতে আসছিল, নানা ধরনের দাদন নিচ্ছিল। এক পীতেম যেদিন জানতে পারল সেদিন সে খুব হেসেছিল। বলেছিল, বা, বাহারে রহু! কি তোর কণ্ঠার হাড়ের কিসমৎ!—আসলে এভাবে সে জিনিসটা সমর্থনই করছিল। আর এইভাবে নিজের ভিতরে সে দ্বিতীয় আর একটি সত্তাকে ক্রমশ স্পষ্ট করে চিনছিল, যে মানুষটা সঞ্চয় চায়, স্থিতি চায়, মর্যাদা চায় এবং সালমার “চল বেরিয়ে পড়ি” কথাতে খুবই অবসন্ন বোধ করে।
বাজারের পাশের ময়দানে ধান ওঠার পরে কালীপুজো হয়। বিশাল কালীমূর্তি। আগে মূর্তি বানানো হয়, তারপর তার মণ্ডপ। সেই উপলক্ষ্যে মেলা।
তখন রাজমহল পাহাড়ের উপর শীত জাঁকিয়ে নামে। পীতেমও তখন তার সবের আয়োজন করে। মাঠের একটা দিক বেশ ভালো করে ঘিরে ফেলা হয়। সন্ধ্যার পর সেখানে অনেক আলো জ্বলে। বেশ খানিকটা দূরে দূরে বাঁশ পুঁতে মশাল জ্বালিয়ে একটা আলো-আঁধারির রহস্য তৈরি করা হয়। একপাশে মদের ভাঁটি বসে দু-দুটো। মিষ্টি ও ভাজার দোকান বসে। মাঝখানের প্রশস্ত জায়গায় বাজিকর যুবক-যুবতীরা শারীরিক কসরৎ দেখায়। চারপাশের আলাদা আলাদা তাঁবুতে আলাদা আলাদা খেলা। কোনোটায় রহু চণ্ডালের হাড়ের কেরামতি—নিমেষে টাকা দ্বিগুণ হচ্ছে, পিতল সোনা হচ্ছে। কোনোটায় নিছক ভাতি—যদুদণ্ডের ছোঁয়ায় যুবতীর লম্বা বিনুনি মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠছে সোজা হয়ে, আবার কোথাও নিমেষে গাছ থেকে ফল, ফুল থেকে ফের গাছ তৈরি হচ্ছে। কোথাও বা বীভৎস নরকযন্ত্রণার মহড়া, যার বিষয়বস্তু বিশ্বাসহন্তার শাস্তি অথবা ব্যভিচারিণী স্ত্রীর কর্মফল। এইসব প্রযোজনায় একজন চতুর কথক থাকে, যে অতিদ্রুত দক্ষ বক্তৃতাবাজিকে তস্করবৃত্তি, বিশ্বাসভঙ্গ, স্বজনগমন ইত্যা অনাচার, লোভ, হিংসা যাবতীয় উত্তেজক ও নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে অনর্গল কথা বলে যায়, অভিনয় করে যা গ্রাম্য মানুষকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে।
সবচেয়ে উত্তেজক ও রোমহর্ষক খেলা বালি বাজিকরের তাঁবুতে (যে খেলার কথা দর্শকেরা বৃদ্ধবয়সে অধস্তন পুরুষের কাছেও গল্প করবে)। বালি একখানা চওড়া কাঠের পাটাতনের সামনে তার যুবতী বউকে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়। চারপাশে তার মশালের আলো জ্বলে। দশ হাত দূর থেকে বালি অত্যন্ত দ্রুতলায়ে একের পর এক ধারালো ছুরি নিক্ষেপ করে ঐ কাঠের উপর তার বউয়ের শরীরের চারপাশে। এক একখানা ছুরি ছুটে যায় আর দর্শক শিউরে চোখ বন্ধ করে, তারপর আবার চোখ খোলে, ততক্ষণে আরেকখানা ছুরি বিদ্ধ হয়েছে নির্দিষ্ট জায়গায়।
পীতেম তার এই বড় খেলায় মানুষ আকর্ষণ করে বিস্তর। শহর ও তার আশপাশের লোকেরা তো আসেই, আসে গঙ্গাঘাটের মহাজনি নৌকোর বাঙালি, মুঘল ও সাহেব ব্যবসাদারেরা, আসে কাছের ও দূরের গ্রামগঞ্জের মানুষ। সমস্ত মাঠে একটা মেলার মতো আয়োজন চলে দশদিন ধরে। পীতেমের পয়সা রোজগার হয় ভালোই। দলের অন্য সবাইও ভালো রোজগার করে। এমনকি সালমাও তার বাণিজ্য ভালোই চালায়।
এর মধ্যেই একদিন দয়ারাম আবার এসেছিল সালমার কাছে। সালমার ওষুধে যে একেবারেই ফল ফলেনি সেকথা জোর দিয়ে দয়ারাম বলতে পারে না। তবে কিনা আরো একটু দ্রুত ফল সে চায়।
সালমা মোহিনী হাসে। দয়ারাম প্রগল্ভ হয়। গলা কাঁপে তার। তারপর সে ফিসফিস করে করুণ আর্তি জানায়, ভান্মতি, একটা উপায় করে দেও। অনেক টাকা দেব তোমায়। সে হাত ধরে সালমার।
সালমা হাত ছাড়িয়ে নেয়। কপট দুশ্চিন্তায় বলে, ভকত, বড় কঠিন ব্যাপার। মানুষ ঠকিয়ে অনেক পয়সা করেছ, সময়মতো ভোগ-আহ্লাদে মন দেওনি, এখন মনে হচ্ছে ঠকে গেছ, নয়?
ভাতি, পয়সার তো অভাব নেই? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সব শেষ হয়ে যাবে, ভাবিনি।
কি করে এত পয়সা করলে, ভকত?
আঃহা, কি করে পয়সা করলাম না? এই জংলির দেশে পয়সা করতে হলে কিছু বুদ্ধি লাগে শুধু। আর কিছু নয়। করবে তুমি পয়সা? শিখিয়ে দেব?
হ্যাঁ, হা, দু-একটা কৌশল শেখাও তো!
দয়ারাম এই বিষয়ান্তরেও সমান উৎসাহ পায়। সারাজীবন ধরে পয়সা রোজগারই তার প্রধান নেশা। পয়সার আলোচনাও তার ভালো লাগে।
সে বলে, ভাতি, এই দেখ শ্যামলাল নায়েবকে কেমন জমিদার বানিয়ে দিলাম। কত পয়সা কামালো লোকটা অবশ্য আমাকেও সিকি ভাগ দিয়েছে, কারণ,
কি, বুদ্ধিটা তো আমার!
শ্যামলাল নায়েবকে কী বুদ্ধি দিলে?
কী বুদ্ধি দিলাম? দেখছ জমির কেমন টান এখন মানুষের? আর শ্যামলাল বহুদিন ধরে নায়েবি করছে, এখন এই শেষ বয়সে একটু আরাম করতে চায় নিজে জমিদার হয়ে। তা সেজন্যই আমার কাছে এসেছিল। পুরানো বন্ধু লোক আমার। রাজমহল পাহাড়ের তিন হাজার বিঘা জমির পাট্টা বিলি হল আর মন্দার পাহাড়ের নাবালেও, তা কম করে আরো পাঁচ-ছ হাজার বিঘা জমির পাট্টা বিলি হল। ভালো সরেস জমি সব। দাম যা পেয়েছে তাতে জঙ্গিপুরে দেখ গিয়ে কেমন জমিদারি কিনে বসেছে।