পেমা সংকোচ বোধ করে না। বেহায়ার মতো হাসে। বলে, হ্যাঁ, এসেছে তোত।
এখন দাম্ভিক পেমা। অথবা, এখনো দাম্ভিক পেমা। যা সালমা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, তা এখন পেমা দেখতে পাচ্ছে না। দেখিয়ে দিলেও দেখবে না হঠাৎ সালমার মায়া হয়, যা তার কদাচিৎ হয়। সে বলে, আনন্দ জানে?
না। আরে সেটাই তো মজা! হেসে গড়িয়ে পড়ে পেমা। যেন ভারি মজার ব্যাপার সে লুকিয়ে একা উপভোগ করছে।
জানলে তোকে রাখবে?
রাখবে না? আমাকে ছাড়া একদিন বাঁচবে না আনন্দ।
তোকে বলেছে?
বলবে কেন? আমি বুঝতে পারি না?
আনন্দর ঘরে বউ আছে না?
থাকল, তাতে আমার কি?
সালমা বোঝে পেমার দম্ভ এখন যে স্তরে আছে, সেখানে আঘাত করলেও ফল হবে না। বস্তুত, বাজিকর মেয়েদের সতীত্বের তেমন বড়াই নেই। কেউ ভ্রষ্টা হলে, দল কিছু শাস্তি অবশ্যই বিধান করে, কিন্তু সে গেরস্থ সমাজের মতো নয়। কিন্তু যাযাবর রমণীরা বেশ্যা হতে কখনোই চায় না। সালমা সে কথাটাই বলে।
আনন্দ তোকে বেশ্যা বানিয়ে রেখেছে।
পিসি!
তবে কি সে তোকে ঘরের বউ করবে?
আনন্দ আমাকে ভালোবাসে।
ভালোবাসা? বাজিকরের বেটিকে গেরস্থ মানুষ ভালোবাসলে তাকে বাজিকর হতে হয়। আনন্দ তোকে রাখনি করেছে। নেশা কেটে গেলে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে।
কখনো নয়।
নির্বোধ এই অল্প বয়সের মেয়েটার জন্য সামলার করুণা হয়। শেষবারের মতো বলে, দল এখান থেকে চলে যাবে ঠিক করেছে, তুই কি করবি?
আমি যাব না, আমি যাব না!
বেশ।
সালমা চলে আসে এবং গীতেমের কাছে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। পীতেম দুঃখ পায়, কিন্তু এ অবস্থায় কি করণীয় তা স্থির করতে পারে না। সালমার কাছে বুদ্ধি চায় সে।
সালমা বলে, এখান থেকে উঠে চল।
পীতেম বলে, এত তাড়াতাড়ি? এখানে রোজগার ভালো হচ্ছিল।
তবে আর কি? থাক। এরপরে মানুষ মেয়েলোকের জন্য ছাউনিতে হামলে পড়বে। তখন কি করে সামলাবি?
এসব শুধু কথার কথা। বাজিকর ভাবে না। ছাউনিতে লোভী পুরুষ হামলে পড়লে ছুরি ঝলসে উঠতে পারে। আবার কোনো ব্যভিচারিণী নিজেই তার প্রেমাস্পদকে ছাউনিতে নিয়ে আসতে পারে। পুরুষেরা এসব দেখেও না দেখার ভান করতে পারে। দলের অন্য কেউ কিংবা বাপ মা-ও না দেখে থাকতে পারে কিন্তু ভাইরা প্রায়শ গণ্ডগোল করে। বিষয়টি বিচিত্র বটে।
কিন্তু পেমার উপাখ্যানে অভিনবত্ব আছে। দলছাড়া যাযাবর মেয়েপুরুষ নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় দেখে। দলত্যাগ করার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবে না। কিন্তু পেমা কি করে এর ব্যতিক্রম হল? পীতেম নিজের ভিতরেই এ প্রশ্নের উত্তর পেতে চায়। গভীর চিন্তা করেও সে কোনোরকম সুরাহা করতে পারে না এ সমস্যার। শেষে নিজেকে একসময় তার অত্যন্ত বৃদ্ধ ও অসমর্থ বোধ হয়। সে তখন সালমার কাছে আশ্রয় খোঁজে।
কিন্তু আশ্চর্য, এতেও সে পুরনো জায়গায় ফিরে আসে না। একসময় সালমা তার দেহের সান্নিধ্যে তাকে স্বস্তি ও উদ্যম দিতে পারত। এখন বয়স তার প্রয়োজনকে কমিয়ে দিয়েছে, কাজেই সে কিছুই ভুলে যেতে পারছে না। ফলে, সে চায় স্থিতি যার অন্য নাম অর্থোপার্জন।
০৯.
বাংলাদেশের বর্ষাকালের ভয়াবহতা সম্বন্ধে বাজিকরদের কোনো ধারণা ছিল না। যারা তাঁবুর নিচে থাকে, বর্ষা সব জায়গাতেই তাদের কাছে আতঙ্কের। গোরখপুরে মাটির ঘরে বর্ষার কয়েকটা মাস ছিল আপাত স্বস্তির। কিন্তু গোরখপুর থেকে চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে আর একটি অনুরূপ বন্দোবস্তের কথা বাজিকর ভাবছিল প্রথম থেকেই। তারা চেয়েছিল এমন একটি জায়গা যেখানে সারা বছর ঘুরে বেড়াবার পর বর্ষার সময়টা অন্তত এসে বিশ্রাম মিলতে পারে। রাজমহলে এসে পীতেমের আশা হয়েছিল এখানে সেরকম একটা বন্দোবস্ত হতে পারে। চারপাশের জমি এখনো খালাস হচ্ছে, নতুন নতুন মানুষ বসতি করছে। যারা বন্দোবস্ত নিচ্ছে তারা প্রায় সবাই চাষি। জমি বন্দোবস্ত নিয়ে তারা জঙ্গল কেটে, জমি সমতল করে চাষের খেত বানাচ্ছে। কিন্তু বাজিকর তো আবাদ করে না, তাকে কে জমি দেবে?
তবুও এমন লোকও পাওয়া যায়। ঈশ্বরপুরের জমিদারির কিছু খাস ছিল রাজমহল পাহাড়ের গায়ে। জঙ্গলাকীর্ণ জমি। জমিদারের নায়েব শ্যামলাল মিশ্র এইসব জমির পাট্টা বিলি করতে শুরু করল রাজমহলের কুন্ঠিতে বসে। একেবারে নগদ কারবার। টাকা ফেলে চাষিরা পাট্টা নিয়ে নিচ্ছে।
খোঁজ পেয়ে পীতেও গিয়েছিল। আগের দু-একবারের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এবারে কিছু তফাত ছিল। আগে দু-বার পীতেম এ ধরনের পাট্টা বিলিতে জমি নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। জমিদারের লোক জমি দিতে রাজি হয়নি। বাজিকর ঘুরে বেড়ানো জাত, তার কাছ থেকে খাজনা পাওয়ার কোনো স্থিরতা নেই।
কিন্তু শ্যামলাল মিশ্র এসব প্রশ্ন তুললই না। তার সম্পর্ক টাকার সঙ্গে কাছারিতে সারাদিন মানুষের আনাগোনা। পত্তনিদার, দালাল, মোসায়েব, গোমস্তা সবরকমের মানুষ জমিপ্রার্থী চাষির সঙ্গে চোটপাট করছে, পয়সা নিচ্ছে।
পয়সা খরচ করে পীতেম পাঁচ বিঘা জমির পত্তনি পেল। শীতেম এবার পেল, কেননা, ঈশ্বরপুরের জমি নিলামের ডাকের মতো ডাক উঠিয়ে তবে বন্দোবস্ত
তারপর পত্তনি জমির দখল দেওয়ার পালায় কাছারির গোমস্তারা তাদের কেরামতি দেখায়। এসব মাপজোখ ভালো ভালো চাষিরাই বোঝে না, বাজিকরের তা প্রশ্নই নেই। জমি মাপার রশির কোনো স্থিরতা নেই। আর থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি। কাজেই হামেশা ষোল-সতেরো কাঠায় বিঘার প্রমাণ হয়। দশ বিঘার পত্তনি রশির মাপে বারো বিঘা দাঁড়িয়ে যায়।