লক্ষ্মণ শান্ত অথচ গম্ভীরস্বরে বলে, এরা আমার অতিথি। তোমার নোক এদের গায়ে হাত দিয়ে ঠিক করেনি।
আরে যা যা, শালা জংলি সাঁওতাল। তোর কাছে জিজ্ঞেস করে তবে আমি কাজ করব?
জবাব সামলে রাখ, বাবু। গতবার তোমাকে বলেছিলাম সরকারি বাটখারা নিয়ে এসে ধান ওজন করবে, অথচ এবারও তুমি এই পাথরগুলো নিয়ে এসেছ।
এই পাথরগুলো আমার লক্ষ্মী, এ পাথর দিয়েই আমি ওজন করব। যার পোষাবে সে আমার সঙ্গে কারবার করবে, যার পোষাবে না, করবে না। এই, তোল, তোল ধান তোল—
থামো, কথা আমার শেষ হয়নি। এ পাথর তোমার লক্ষ্মী, আমরা জানি, কিন্তু ও পাথর সাঁওতালের দুশমন। আমার ঘরে পাঁচসেরি সরকারি বাটখারা আছে। এবার তোমাকে সেই বাটখারা দিয়ে ধান মেপে নিতে হবে। কি, রাজি?
পতিত সাউয়ের কণ্ঠস্বর নিমেষে চাপা তর্জনে নেমে আসে। সে কেটে কেটে বলে, লক্ষ্মণ সোরেন, এবার তোর মরণের পাখা গজিয়েছে। নিজের ভালো চাস তো আমার কাজে বাধা দিতে আসিস না।
এই শেষ কথার পর ডুমকা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। লক্ষ্মণ হাত তুলে তাকে নিষেধ করে। লক্ষ্মণ পতিত সাউয়ের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। পতিত হঠাৎ যেন নিজের দুর্বলতা দেখে লজ্জা পায় এবং ওজনদারকে ধমক দিয়ে ওঠে, এই শালা, ধান তোল, ধান তোল।
খবরদার!
লক্ষ্মণ এবার প্রচণ্ড ধমকে সমস্ত চাঞ্চল্য স্তব্ধ করে দেয়। তার পিছনে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। পতিত সাউ যেন উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসও শুনতে পায়।
সে বলে, আচ্ছা, আমিও দেখব। এই চল সব।
দলবল নিয়ে সে ক্রুদ্ধ পশুর মতো ফিরে যায়। লক্ষ্মণ তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর একজন বয়স্ক মাঝিকে বলে, হাড়মা, সব মহাজনকে জানিয়ে দে এবার সরকারি বাটখারায় ধান মেপে নিতে হবে। আমার বাড়িতে লোহার বাটখারা আছে। তাতে রাজি না হলে, তারা এবার ধান নিতে পারবে না।
জিল্লুর আঘাত গুরুতর নয়। কানের পাশে একটা জায়গা লাঠির ঘায়ে থেঁতলে গেছে খানিকটা। ফেরার পথে পীতেমকে লক্ষ্মণ বলে, সর্দার, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার।
পীতেম বলে, ক্ষমা বরং আমিই চাইব, পারগানা। আমার লোকই তো এসব ঝামেলা বাধালো।
না, তা নয়, তা নয়। এ ঝামেলা বাধতই। কতদিন মানুষ সহ্য করে? তোমাদের ছেলে উপলক্ষ মাত্র। হয়ত, এ ভালোই হল। একটা মুখ দরকার ছিল বাঁধা ভাঙার। জিল্লু সেই মুখটা খুলে দিয়েছে। তবুও তোমার অপমান হল, এই আমার লজ্জা।
এ ঘটনার পর লক্ষ্মণ অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে গেল। পীতেম লক্ষ করল, কয়েকজন যুবককে কি কি নির্দেশ দিয়ে সে বিভিন্ন গ্রামে খবর দিতে পাঠালো। একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতা।
তৃতীয় দিনে পীতেম বলল, আমরা এবার ফিরে যাব, পারগানা, অনুমতি কর।
লক্ষ্মণ বলে, বুদ্ধিমান লোক তুমি, তাই আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছ, নয়?
কেমন?
ঢাকাঢাকির কোনো ব্যাপার নেই সর্দার। তোমার এখন যাওয়াই আমি চাচ্ছিলাম। বড় মুখ করে ডেকে এনে বিপদে ফেললাম তোমাকে। তোমার এখন যাওয়াই ভালো। পতিত সাউ, গোরাচাঁদ এরা আমাকে ছেড়ে দেবে না। পুলিশদারোগা এদের জাতভাই। তারা আসবে।
হুজ্জতি হবে?
হবে।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পীতেম বিদায় নেয়। কিন্তু গ্রাম আড়াল হতেই জিল্লুকে সে শাসন করে। কি দরকার ছিল তোর পারের বেপারে নাক গলানোর!
জিল্লু অবাক হয়, বাঃ, বোকা গেয়ে লোকগুলোকে ঠকাচ্ছে, দশ সেরকে পাঁচ সের বানাচ্ছে, কিছু বলব না।
না, বলবি না। আমরা হলাম বাজিকর। গেরস্থের হাল-হকিকতের আমরা কি বুঝি! আমাদের তো রাস্তাতেই থাকতে হবে।
০৮.
রাজমহলে ফিরে এসে পীতেম সংবাদ পায় পেমা পালিয়ে গেছে। ধন্দু জানায় পেমাকে আনন্দরাম শহরের মধ্যে একটা কোঠা বাড়িতে রেখেছে। বাইরের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ধন্দু জানেও না পেমা সেখানে স্বেচ্ছায় আছে, না, জবরদস্তি আছে। তবে দরজায় পাহারা আছে চব্বিশ ঘণ্টাই।
বেপরোয়া পরতাপ এ খবরে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়। সে প্রকাশ্যেই বলতে থাকে যে দু-জনকেই খুন করবে। পীতেম ধমক দিয়ে তাকে থামাতে পরতাপ বউয়ের উপরে গিয়ে তন্বি করে। তুইই আমাকে মিথ্যা বলেছিলি। সেদিন আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।
সালমা পীতেমকে বলে, তাদের বাজিকরদের হালচালই এইরকম। সব সময় গেরস্থ মানুষের পানে নোলা বাড়ানো স্বভাব। পেমার দোষ দিয়ে লাভ কি? এ তো জাতের দোষ! দেখে আসলি না, কেমন সুখের কপাল গেরস্থ মানুষের!
তারপর অবশ্য সালমাই পেমার সঙ্গে দেখা করে আসে। পাহারাদারকে কথায় ভোলাতে তার সময় লাগে না বেশি।
পেমার সামনে এসে প্রথমে কথা বলে না সালমা। পেমা বলেছিল, আনন্দ যদি চায় আমি ঘোড়ি হই, তো আমি ঘোড়ি হব। সালমা দেখতে চায় পেমার সে তেজ এখনো আছে কিনা দেখে আশ্চর্য হয় যে সে তেমনি আছে।
পেমা হেসে বলে, খুব অবাক হচ্ছ পিসি?
সালমা তুচ্ছার্থক ধ্বনি করে। বলে, অবাক হব কেন? বাজিকরের জাতটাই তো এমন, যে-কোনো ছুতোয় বাঁধা পড়তে চায়। কি সুখে আছিস এখানে?
কেন? দুঃখ কিসের আমার? চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দু-জন মানুষ আমার সেবা করে। এই দেখ শাড়ি, এই দেখ কত গয়না।
আনন্দ পয়সা পায় কোথা এত?
জমিজমা আছে, মহাজনি কারবার আছে। দারোগা তো সেসব দেখাশুনা করে না, আনন্দই দেখে।
তবে ভালোই আছিস?
হ্যাঁ।
দারোগা কিছু বলে না?
বলবে কি? তার তো নিজের তিনজন মেয়েমানুষ আছে।
সালমা পেমার সর্বাঙ্গে তাকিয়ে তার অধঃপতন দেখে। শেষে একটু আতঙ্কিত হয়। বলে, তোর পেটে বাচ্চা এসেছে, মনে হয়?