তারপর বাজিকরেরা একদিন দেখতে পেল কাটা ধানের খেতের ভেতরের আল কেটে কেটে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি ঢুকছে সার বেঁধে। গাড়িগুলো এ গ্রাম সে গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে। বহেরাতে দশখানা গাড়ি এ গ্রাম সে গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে। বহেরাতে দশখানা গাড়ি এল এক দিনেই।
পীতেম একসময় লক্ষ্মণকে জিজ্ঞেস করে, এসব ফসল তোমাদের নয়?
আমাদেরই, আবার আমাদেরও নয়ও।
কেমন?
মানুষ সব বাঁধা হয়ে আছে ধারে দেয়। এখন সেসব উশুল হবে। দেখছ, মহাজনরা সব এসে হাজির হয়েছে?
এরা সব মহাজন?
হ্যাঁ। ঐ যে কুঁজো মতো লোকটাকে দেখছ, ও হল পতিত সাউ। দশ বছর আগে বর্ধমান না কোথা থেকে যেন আসে এখানে। হাটে তামাক পাতার দোকান নিয়ে বসত। পাঁচ টাকার মালও রাখতে পারত না, এমন দুঃস্থ ছিল। এখন লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক।
কি করে হল?
সাঁওতালের রক্ত নিঙড়ে হল। বেশিদিনের কথা নয় সর্দার, এইসব জমি, যতদূর তোমার চোখ যায়, এইসব জমি’ আমরা জঙ্গল কেটে পাথর চটিয়ে খালাস করেছি। তখন কোনো ভাগীদার ছিল না। তারপরে পাকুড়ের রাজারা বেশি খাজনা পাবার আশায় সব জমি পত্তনি দিয়ে দেয়। পত্তনি গ্রাম গ্রাম ঘুরে আওয়াজ তোলে, যে চাষা টাকায় সিকি খাজনা এখন বেশি না দেবে তার সঙ্গে আর নতুন করে বন্দোবস্ত হবে না। তারপরে জরিপের জন্য যে রশি ফেলে তার মাপ পরিমাণ তারাই বোঝে, কি তারাও বোঝে না। এইভাবে পত্তনিদার আবার দরপত্তনিদার, ছে-পত্তনিদার, ইজারাদার, ছে-ইজারাদার নিয়োগ করে। সর্দার, চোখ বন্ধ করলে মানুষ নায়েব, গোমস্তা, তশিলদার, পাইক, চৌকিদার, দারোগা এসব চোখের সামনে দেখে। সবাই খালি হাত পেতে আছে। না দিলেই হুজ্জত। না দিলেই তোমার সর্বনাশ। অথচ আগে এমন ছিল না। আমার খাটনির ভাত আমিই খেতাম, আর কেউ নয়। এখন আমার খাটনির ভাত, আমি ছাড়া আর সবাই খায়!
পারগানা, তুমি এত বোঝ! আর রাজমহলের মানুষ বলে সাঁওতাল হল জংলি জাত, বোধভাষ্য নেই।
হাঁ, তারা এমন ভাবে বটে। পাঁচ শলি ধান মহাজনের কাছ থেকে সাঁওতাল ধার নিলে দেড় বছরে কত ফেরত দিতে হয় জান?
কত?
হিসাব করতে জান তুমি?
জানি।
তবে দুনা হিসাবে হিসাব কর।
দশ শলি।
হল না।
তবে?
দেড় বছরে—ধর, প্রথম সনে ধান দেওয়া গেল—হয় ফসল হয়নি বা অন্য কোনো কারণ। সুতরাং তার পরের বছর।
বিশ শলি?
হল না।
হিসাবে তো তাই হচ্ছে।
সর্দার হিসাবটা কার, সেটা দেখতে হবে।
কার হিসাব?
হিসাব পতিত সাউয়ের, হিসাব দয়ারাম ভকতের, হিসাব গোরাচাঁদ সেনের।
হিসাব তো একই হয়, হিসাব আবার আলাদা হয় নাকি?
হয় না? পতিত সাউয়ের হিসাবে এই বিশ শলি ধান তুমি আলাদা নিয়ে ওজন কর,!! 1. চল্লিশ শলি হবে। আবার অন্য দু-জনার ওজন করা ধান নিয়ে আলাদা ওজন কর, যা বলবে তার দেড় তো হবেই।
মানুষ দেয়।
সাঁওতাল দেয়।
বুঝে দেয়, না, না, না বুঝে দেয়?
বুঝেও দেয়, না বুঝেও দেয়।
কেন দেয়?
হায়রে সর্দার! আশপাশের দশটা গ্রামের পারগানা আমি। নিয়ম করে দিয়েছি, ধান উঠলে পরে শহরায় উৎসব হবে, কার্তিক মাসের অমাবস্যায় হবে না। কারণ কি?
কি?
পাঁচ টাকা বেনিয়ার কাছ থেকে কর্জ নিয়ে সারা জীবন বেগার দিয়েছে আমার এলাকার মঙ্গল মুর্মু, সেই দেনা এখনো শোধ হয়নি। দয়ারাম ভকতের ঘরে তার বেটা সুফল এখনো বাঁধা চাকর হয়ে আছে। সাঁওতাল কর্জ নিলে তা আর বংশসুদ্ধ মরে হেজে না গেলে, শোধ হয় না।
এসব কথাবার্তা হচ্ছিল লক্ষ্মণের বাড়ির উঠোনে বসে। তিন পাশে ধানের মরাই উঠেছে উঁচু হয়ে লক্ষ্মণের ছেলেরা এবং অন্য কয়েকজন পাটার উপর ধান মাড়াই করছে। একপাশে পীথা ও অন্য কয়েকজন রমণী কুলো দিয়ে বাতাস কেটে মরা ধান পরিষ্কার করছে। লক্ষ্মণের বাড়ির মুরগি ও শুয়োরগুলো সুযোগ পেলেই ধানে মুখ দিচ্ছে। বহেরায় লক্ষ্মণই একমাত্র ব্যক্তি যার কোনো ঋণ নেই। পীতেম এইসব গেরস্থালি কাজকর্ম নজর করে দেখছে ও লক্ষ্মণের কথা শুনছে।
এমন সময় গ্রামের অন্যপ্রান্তে একটা হৈ-চৈ শোনা যায়। উত্তেজিত গলা মানুষের। সবার উপরে একটা তীক্ষ্ণ চেরা গলার তর্জনগর্জন। লক্ষ্মণ উত্তর্ণ হয়ে শুনল। গণ্ডগোল ক্রমাগত বেড়ে চলায় তাকে উঠতে হল। পীতেমও তার সঙ্গে
একটা অপ্রশস্ত উঠোনে ধান মাপা হচ্ছে। গণ্ডগোল সেখানে। চেতন মাঝির বাড়ি সেটি। এখন উত্তেজনা অপেক্ষাকৃত শান্ত। কিন্তু লক্ষ্মণের সঙ্গে পীতেম সেখানে উপস্থিত হয়েই বোঝে, একটা চাপা ত্রস্ত ভাব স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে। একপাশে একটা খাটিয়ায় জিল্লু শুয়ে আছে, তার মাথায় ও গালে রক্ত। কয়েকজন সাঁওতাল যুবক তাকে নানাভাবে শুশ্রুষা করবার চেষ্টা করছে।
জিল্লুকে ঐ অবস্থায় দেখে পীতেম ও লক্ষ্মণ দুজনেই তার কাছে দৌড়ে আসে।
কি করে হল এসব?
পীতেম সমস্ত উঠানটা খুঁটিয়ে দেখে একপাশে আড়াআড়ি জোড়া বাঁশে ঝোলানো দাঁড়িপাল্লা। ওজন করার সিঁদুরের দাগ দেওয়া পাথর। লক্ষ্মণের পরিচিতি মতো পতিত সাউ দু-হাতে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ানো। তার সামনে ছ-জন লাঠিধারা। একজন বৃদ্ধ, সম্ভবত চেতন মাঝি, উবু হয়ে বসে। তার দুই হাঁটুর ভিতরে মাথা, দুইকানের উপর হাত।
পীতেমকে দেখে পতিত সাউ হুংকার দিয়ে ওঠে, পারগানা, এ ছোকরা কে?
লক্ষ্মণ সে কথার উত্তর দেয় না? জিল্লুর পাশে বসা ডুমকাকে সে জিজ্ঞেস করে, কি করে হল, এসব?
জিল্লু ওজনের কারচুপি ধরেছিল।
পতিত তার কথার উত্তর না পাওয়াতে সম্ভবত অপমান বোধ করে। সে এগিয়ে এসে বলে, আমি জানতে চাই এ ছোকরা কে, আর কেন আমার কাজে বাধা দেয়?