রাস্তায় সাঁওতাল গ্রামগুলিতে ঢোকার মুখে তারা দেখল গাছের গায়ে গরুর চামড়া ও আড়াআড়ি একজোড়া বাঁশি টাঙানো। তারা দেখল মোড়ে মোড়ে পুঁতে রাখা ঝাণ্ডা, ঘণ্টা, ভাঙাকুলো।
গ্রামে ঢোকার আগেই বাধা পায় বাজিকরেরা। প্রথমত বিদেশি চেহারা, তার উপরে ঘোড়সওয়ার। পথ আটকায় সাঁওতাল মানুষ।
কে যায়?
আমরা বাজিকর।
কোথায় যাওয়া হবে?
যাব দিঘি থানার বহেরা গ্রামে।
সেখানে কি দরকার?
সেখানে পারগানা লক্ষ্মণ সোরেন আমাদের বন্ধু লোক, শহরায় নেমন্তন্ন আছে।
রাস্তা ছেড়ে দেয় মানুষ। পীর্তেমের দল অগ্রসর হয়। মাঠে মাঠে পাকা ধান এ শাটার অপেক্ষায়। বাসে তার সুঘ্রাণ। পাখপাখালি সারা মাঠে উল্লাস জুড়েছে। পরিচ্ছন্ন সাঁওতাল গ্রামগুলোতে শহরায়-এর উৎসব শুরু হয়ে গেছে। পাওমের ভারি ভালো লাগে।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে কোনো গ্রামে তারা রাত্তিরের মতো আশ্রয় নেয়। গ্রামের সর্দারেরা পীতমের কথা জানে। হয়ত লক্ষ্মণের ব্যবস্থাই এই রকম।
কে যায়?
আমি পীতেম বাজিকর।
কোন পীতেম? পারগানা লক্ষ্মণ সেরেনের বন্ধু বটে?
তাই বটে।
বসো হে কুটুম। আজ রাতে এখানেই কুটুম কর, বিশ্রাম কর, খাও দাও, নাচ গান দেখো।
এরকম একটি নাচ-গানের আসরে পীতেমরা একটি অদ্ভুত গান শোনে। গানটি বড় বিষাদের। গানটিতে স্ত্রী তার স্বামীর উদ্দেশে বলছে।
বাবারা আর ভাইয়েরা শুয়োর বলি দিচ্ছে, সাদা মোরগ বলি দিচ্ছে, সব জামাইরা হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে, পানভোজনের আনন্দ উপভোগ করছে। হায়রে, হায়রে, একজন মানুষ শুধু ভকত দয়ারামকে পিঠের উপরে বয়ে বেড়াচ্ছে।
চকিতে বাজিকরদের সেই দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে, যখন দয়ারাম ভকত মোষ কিনতে এসেছিল। সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে, যার ঘাড়ে পা রেখে দয়ারাম ঘোড়র উপরে আড় হয়ে বসে।
বহেরা গ্রামে বাজিকরেরা পৌঁছালে, লক্ষ্মণ সোরেন সপরিবারে পীতেমের দলকে প্রত্যুদগমন করে। এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা বাজিকরেরা কোনদিন পায়নি। সমস্ত ঘরবাড়ি নিপুণ করে নিকোনো, ঝকঝকে পরিষ্কার উঠোন। প্রবীণরা এসে সম্মান জানায় পীতেম, সালমা ইত্যাদি প্রবীণদের। পরতাপ এবং জিল্লু পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কলরব করে।
সন্ধ্যার পর লক্ষ্মণ সোরেন, তার স্ত্রী পীথা মুর্মু এবং অন্যান্য প্রবীণদের সঙ্গে পীতেম সালমা বসে শহরায় উৎসবের কথা শোনে। নিয়মমতো, কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে শহরায় পূজা হয়। কিন্তু এখন আর সব নিয়ম ঠিকমতো মানা যাচ্ছে না। সাঁওতালরা মহাজন, মালিকের শোষণে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ফলে ধান ওঠার আগে উৎসবের কথা কেউ ভাবতে পারে না। এখন তাই অঘ্রান মাসেই উৎসব হয়। উপায় কি? শহরায়ে যে ঠাকুর-ঠাকুরানের পূজা হয় তাঁরা শস্য ও পালিত পশুর শ্রীবৃদ্ধি করেন, নিরাপদে রাখেন। গোয়ালঘরে মারাংবুরু এবং ঠাকরানের পূজা হয়-আতপ চাল, মেথির গুঁড়া, তেল-সিঁদুর দিয়ে গোলাকার “খড়” সাজানো হয়। বলি দেওয়া হয় মোষ, শূকর, মোরগা। মোষ বলির চিন্তা এখন আর কেউ করে না, তবে শুয়োর ও কাটোল মুরগি বলি হয়। মানুষ প্রচুর নেশা করে। নাচ-গান চলে কয়েক দিন ধরে।
এবার যেসব নতুন গান বাঁধা হয়েছে, তার অধিকাংশই মানুষের দুঃখকে নিয়ে। একটি গানে বলেছে—
রাজমহল পাহাড়ে,
গাড়ি চলে লহরে,
চার হালের মোষ বেচে
হায়রে, হায়রে,
মরদ গেল শহরে।
হায়রে, হায়রে,–
গোমানীর জল গেল শুকিয়ে।
অথবা,
পারগানার কাছে নালিশ জানালাম,
পারগানা চুপ করে থাকে।
আমার বিচার করে দারোগা,
আমার বিচার করে মহাজন,
আমার বিচার করে
ঘোষা নালার ঘাটোয়াল।
পারগানা চুপ করে থাকে।
অথবা,
পারগানার কাছে আর্জি জানালাম,
হায়রে, হায়রে, মিছাপুর মেলায়,
কেনারাম দারোগা পেয়াদার জন্য
হায়রে, হায়রে! মিছাপুর মেলায়!
নির্দয় দারোগা, ধূর্ত পেয়াদা,
মনে প্রাণে সুখ নেই,
দারোগা ঘোড়ার উপর টাপটাপ যায়—
কোমরে পেতলের বেল্ট,
উজ্জ্বল পোশাক
আমার সুখ নেই।
পারগানা লক্ষ্মণ সোরেন এসব গান শুনে বিষণ্ণ হয়ে যায়। পীতেম তার পাত্রে মদ ঢেলে দেয়। লক্ষ্মণ ম্লান হেসে পানপাত্ৰ-মুখে তোলে। এক ঢোক খেয়ে, তারপর বলে, আমি কি করব বল? আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমার কি করবার আছে।
কথাবার্তা হয় আঞ্চলিক বাংলায়, বাজিকরেরা যে ভাষাটা ভালোই আয়ত্ত করেছে। গানগুলোর অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছে জিল্লু, যে আগেকার ছ-মাসে এদের ভাষাটা মোটামুটি ভালোই শিখেছে। বাজিকর অন্যদের ভাষা চট করে ধরে নিতে পারে। কিছু কিছু গান আবার বাংলাতে হয়, কিছু বাংলা ও সাঁওতালি মিশ্র ভাষায় হয়।
পরতাপ ও জিন্ধু সাঁওতাল যুবক-যুবতীর নাচের তালে তালে চমৎকার পা মেলাতে শিখেছে। এতে উভয় পক্ষই প্রচুর কৌতুক বোধ করে। ডুমকার মা পীথা একসময় সালমাকেও টেনে নামায়। বাজিকরদের কিছু নিজস্ব নাচও আছে। সালমা মাথায় রুমাল বেঁধে দলের আরো পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে হাততালি ও গান সহকারে নাচে। পীতেম জিল্লুর কাছ থেকে ঢোলক টেনে নিয়ে বোল তোলে।
প্রচুর উচ্ছ্বাস ও কোলাহল হয়। প্রবীণেরা পুনরুজ্জীবিত বোধ করে। দিন কেটে যায় অত্যন্ত দ্রুত। উৎসব তারপর স্তিমিত হয়ে আসে।
নতুন উৎসব শুরু হয় তারপরে। সে উৎসব ফসল কাটার। মানুষের পরিশ্রম যেন পরিশ্রমই নয়। সারাদিন মাঠের পর মাঠ ধান কাটা ও সেগুলো ঘরে বসে আনা। অফুরন্ত উৎসাহ। পীতেম অবাক হয়ে দেখে, জিল্লু ও পরতাপ এ কাজেও বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এই নিতান্ত গেরস্থালি কাজটাতে তারা সমান উৎসাহ বোধ করছে।