সে বলল, হবে হয়ত আড়ালে গিয়েছিল। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, তোমার কথা তো কিছুই শোনা হয়নি কাল। কি করে ছিলে এতদিন আমাকে ভুলে?
পরতাপ তাদের অজ্ঞাতবাসের কথা বলে, যার প্রথম পর্ব গতানুগতিক। মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পথেই ডাকাত তাদের ধরে। তারা লুণ্ঠিত ও আহত হয়। টাকাকড়ি ও ঘোড়া দু-টি দস্যুরা নিয়ে যায়। মাথায় আঘাত পেয়ে জিল্লু অচৈতন্য হয়ে পড়ে। পরতাপ হাঁসুয়ার কোপ হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে জখম হয় এবং দৌড়ে জঙ্গলে পালিয়ে বাঁচে।
পরদিন সকালে শিকার থেকে ফেরত একদল সাঁওতাল তাদের ওই অবস্থায় দেখে তুলে নিয়ে যায় নিজেদের গ্রামে।
সেই গ্রাম ডুমকাদের। পাহাড়ের উপত্যকায় সবুজ সেই গ্রামে মানুষ খুব প্রাণবন্তু, জীবন খুব বেগবান।
তাহলে সেখানে ভালোই ছিলে? আমাদের কথা যখন মনেই পড়েনি!
খারাপ ছিলাম কি করে বলি? সমস্ত ব্যাপারটাই নতুন তো।
সবই নতুন। পরতাপ ওজিল্লু সেখানে অনেক কিছু শিখেছে যার সঙ্গে বাজিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে তারা ধান কেটেছে, ধান মেরেছে। বলদ দিয়ে সর্ষেকলাইয়ের খেত চষেছে। দেখেছে কেমন করে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মাঠ সবুজ হয়ে যায় এবং তাতে শরীরের ভিতরে কেমন খুশি শিহরণ জাগে। সন্ধ্যার পরে তারা অন্য সবাইয়ের সঙ্গে উদ্দাম হয়ে নাচ গান করেছে, নেশা করেছে পচানি ও তালের রসের। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দল বেঁধে শিকার খেলা। শিকারের উত্তেজনার কাছে কোনো কিছুই লাগে না। এমনকি বাজিকরের জানোয়ার চুরি করাও নয়। ধাবমান জানোয়ারকে তীরবিদ্ধ করা, আক্রমণােদ্যত জন্তুকে সাহসের সঙ্গে ঘায়েল করা এক বিরাট অভিজ্ঞতা। এইসব কাজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে, বুঝতে পারে মানুষের জন্মের কারণ এবং জীবনের অর্থ।
আর কিছু? আর কিছু?
কি আর?
কোনো সঙ্গিনী জোটেনি? এদ্দিন থাকলে?
কেন? তুমি জুটিয়েছ নাকি এর মধ্যে?
জোটাইনি। তবে ভাবছিলাম।
কি ভাবছিলে?
ভাবছিলাম, জীবন কিভাবে কাটবে? ভাবছিলাম, কি নিয়ে থাকব?
তাহলে, আমি ছাড়াও চলে?
কি দেখলে এত ঘুরে এসে? আমি ছাড়াও তো তোমার চলেছে। কাছে থাকলে মানুষ একরকম থাকে, দূরে গেলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়, ভুলে যায়। তুমি দুনিয়া ঘুরে এসে একথা বুঝলে, আর আমি তো একা এখানে বসে সেই কথা শিখলাম।
খুব ভেবেছ এ কয়মাস, না?
ভেবেছি, খুবই ভেবেছি প্রথম প্রথম।
তারপরে?
তারপরে সব আবার পুরনো হয়ে যায়। তখন আবার নতুন করে ভাবনা শুরু হয়।
তুমি অনেক বদলে গেছ।
তুমিও কি সেই মানুষ আছ? তা যাকগে, তারপর তোমার কথা বল। শুধু ভাবতে অবাক লাগছে যে, এত দীর্ঘ দিন না তোমাদের আটকে রাখল, সে কোন জিনিস?
পরতাপ যা বলতে পারে না তার নাম জীবন। সমস্ত যাযাবরী চাঞ্চল্যেও একসময় ক্লান্তি আসে। একঘেয়ে লাগে। যাযাবর তখন নতুন রাস্তায় পা বাড়ায়। কিন্তু সব রাস্তাই প্রাচীন এবং প্রথম চমক কেটে গেলে যাযাবর বোঝে সেই একই জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে।
জিল্লু ও পরতাপ সেই একঘেয়েমি থেকে কিছুদিনের জন্য নিষ্কৃতি পেয়েছিল। সেজন্যই এই বিস্মরণ। আর যেখানে ছিল সেখানে জীবন অঢেল। মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদ্যতা অটুট। এমন চমৎকার একাত্মবোধ তারা সারা দুনিয়ার আর কোথাও দেখেনি।
০৭.
প্রায় এক মাস পরে দুমকা সম্পূর্ণ সুস্থ হলে লক্ষ্মণ তাকে নিয়ে নিজের গ্রামে চলে গেল। যাওয়ার সময় পীতেমকে বলল, যদি নেমন্তন্ন পাঠাই, যেতে হবে কিন্তু।
পীতেম বলে, কথাটার মানে বুঝলাম না। যদি নেমন্তন্ন পাঠাই’ মানে কি? ‘যদি কেন?
এই একমাসে তাদের সম্পর্ক এমনই গভীর হয়েছে। প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ পীতেম লক্ষ্মণকে দিয়েছে একখানা অদ্ভুত আকৃতির হাঁসুয়া, যার হাতলটা ছোট কিন্তু ধাতব অংশটা চওড়া ও ভারি। ধারালো অস্ত্রটার এক কোপে একটা পশুর মাথা নামিয়ে দেওয়া যায়।
লক্ষ্মণ বলেছিল, ‘যদি’র মানে এই যে দিনকাল খারাপ। তারপরে একমাসের উপরে ঘরছাড়া। ওদিকের কি অবস্থা, কে জানে? তবুও কথা রইল, ডাক দিলে সাড়া দিও।
পীতেম বলেছিল, দেব।
তারপর রাজমহল শহরের উৎসবের মাস শেষ হলে লক্ষ্মণ সেরেনের নেমন্তন্ন এসেছিল। লক্ষ্মণ তাদের শহরায়ু উৎসবে যোগ দেবার জন্য পীতেমকে সদলে নেমন্তন্ন করেছিল।
বাজিকরেরা ইতিমধ্যে নিজেদের কিছু শ্রীবৃদ্ধি করেছিল। শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন এই তিন মাসে চাষি গৃহস্থের বড় দুঃসময় কাটে। এই সময় তাদের সঞ্চিত সম্পদ সব ব্যয় করতে হয়। কৃষকদের সঞ্চিত সম্পদ হল তার গৃহপালিত পশু। প্রথমে তারা এইসব পশু বেচে খায়, তারপর মহাজনের কাছে হাত পাতে।
কাজেই পশুর দাম এসময় একেবারে পড়ে যায়। বাজিকরেরা এবার অনেক পশু কিনেছে। পীতেমের দলে এখন ঘোড়াই আছে বারোটা, মোষ, শুয়োর, ভেড়া ইত্যাদিও অনেক। গরু ও বকরি তারা রাখে না, কারণ এই জানোয়ারগুলো তেমন কষ্টসহিষ্ণু নয় এবং রাস্তাঘাটের জীবনে অভ্যস্তও নয়।
পীতেমের জানোয়ারগুলো এখন রাজমহলের পাহাড়ের বর্ষার পরের অফুরন্ত সবুজ ঘাসে চরে ও স্বাস্থ্যবান হয়। স্বাস্থ্যবান জানোয়ারের মালিকানায় বাজিকরেরা বরাবরই খুব গর্বিত।
লক্ষ্মণের কাছ থেকে আমন্ত্রণ আসাতে পীতেম মনে মনে আনন্দ ও গর্ব বোধ করে। বাজিকরকে কেউ কোনোদিন নেমন্তন্ন করে না। তার সঙ্গে কুটুম্বিতা করার কথা কেউ ভাবে না। লক্ষ্মণ সেই মর্যাদা দিয়েছে তাদের, এ কি কম কথা?
কার্তিকের শেষে পীতেম, সালমা, পরতাপ, জিল্লু ইত্যাদি দশজন বাজিকর দশটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বহেরা আসে।